1 min read

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: নতুন এক প্রযুক্তির উত্থান ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: নতুন এক প্রযুক্তির উত্থান ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ

আমরা এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে মানুষ প্রথমবারের মতো তার নিজের তৈরি করা 'কিছু'র কাছে নিজের অস্তিত্বের হুমকি অনুভব করছে।

হাজার হাজার বছর ধরে আমরা এই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে রাজত্ব করেছি।

তথাকথিত 'আফ্রিকার এক কোণের নগণ্য বানর' থেকে আমরা হয়ে উঠেছি সমগ্র পৃথিবীর শাসক।

কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এমন কিছু তৈরি করছি যা খুব শীঘ্রই আমাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে!

AI: শুধু যন্ত্র নয়, একটি স্বাধীন সত্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-কে আমরা যদি অন্যান্য মানব আবিষ্কারের মতো একটি সাধারণ যন্ত্র মনে করি, তাহলে আমরা ভুল করব।

ছাপাখানা, পারমাণবিক বোমা কিংবা অন্যান্য যন্ত্র আমাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, কিন্তু তারা আমাদের ছাড়া কিছুই করতে পারে না। একটি ছাপাখানা নিজে থেকে বই লিখতে পারে না, পারমাণবিক বোমা নিজে থেকে লক্ষ্য বেছে নিতে পারে না।

কিন্তু AI ভিন্ন।

এটি একটি এজেন্ট!

যে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে, শিখতে পারে এবং নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে।

AI-এর সংজ্ঞাই হলো এমন কিছু যা নিজে থেকে শিখতে এবং পরিবর্তিত হতে পারে। যদি কোনো মেশিন শুধুমাত্র পূর্ব-নির্ধারিত নির্দেশ অনুসরণ করে, তাহলে সেটি কফি মেশিন, AI নয়।

শিশুর মতো AI: আমাদের আচরণ দেখে শেখে

AI-কে আমরা একটি শিশুর সাথে তুলনা করতে পারি।

একটি শিশুকে আপনি যতই ভালো শিক্ষা দিন, সে আপনাকে অবাক করবে—ভালোর জন্য হোক কিংবা মন্দের জন্য। শিশুরা আমাদের কথার চেয়ে আমাদের কাজ থেকে বেশি শেখে।

আপনি যদি আপনার সন্তানকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করেন, কিন্তু তারা আপনাকে অন্যদের সাথে মিথ্যা বলতে দেখে, তাহলে তারা আপনার আচরণ অনুসরণ করবে, আপনার নির্দেশ নয়।

ঠিক একইভাবে,

যখন আমরা AI-কে মিথ্যা না বলতে শেখানোর চেষ্টা করি, কিন্তু AI দেখে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষরা মিথ্যা বলছে, তখন সে সেই আচরণই অনুসরণ করবে। যারা মনে করেন যে তারা মিথ্যা বলতে বলতে AI-কে সততা শেখাতে পারবেন, তারা ভুল ভাবছেন।

ক্ষমতা বনাম প্রজ্ঞার দ্বন্দ্ব

মানব সভ্যতার ইতিহাসে আমরা ক্ষমতা অর্জনে অত্যন্ত দক্ষ হয়েছি। চাঁদে যেতে পারি, পরমাণু ভাঙতে পারি, কিন্তু প্রস্তর যুগের মানুষদের চেয়ে আমরা বেশি সুখী নই।

আমরা ক্ষমতাকে সুখে রূপান্তরিত করতে জানি না। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষরাও সবচেয়ে সুখী নন।

আমরা বুদ্ধিমত্তাকে জ্ঞান ও সত্যের সাথে গুলিয়ে ফেলি। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতি, কিন্তু একইসাথে সবচেয়ে বিভ্রান্ত প্রজাতিও।

অন্য কোনো প্রাণী এমন অদ্ভুত বিশ্বাস করে না যে, অন্য প্রাণীদের হত্যা করলে মৃত্যুর পর স্বর্গে পুরস্কার পাওয়া যাবে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বিশ্বাসে এতটাই দৃঢ় যে তারা প্রকৃতপক্ষে মানুষ হত্যা করে।

AI-এর প্রভাব: অর্থনীতি থেকে ধর্ম পর্যন্ত

AI প্রথমে অর্থব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনবে। কারণ অর্থ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে তথ্যভিত্তিক। তথ্য প্রবেশ করে, তথ্য বের হয়।

রাস্তায় স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালানো কঠিন কারণ সেখানে পথচারী, রাস্তার গর্ত ইত্যাদি জটিল ভৌত সমস্যা রয়েছে। কিন্তু অর্থব্যবস্থায় এসব নেই।

AI এমনকি ধর্মেও পরিবর্তন আনবে। ইহুদি, ইসলাম, খ্রিস্টধর্মের মতো গ্রন্থভিত্তিক ধর্মগুলি গ্রন্থকে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব দেয়।

আজ পর্যন্ত মানুষই এই ধর্মগুলির প্রধান কর্তৃত্ব ছিল কারণ গ্রন্থ নিজে কথা বলতে পারে না। কিন্তু AI এমন একটি গ্রন্থ তৈরি করতে পারে যা নিজেই কথা বলতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।

AI-এর কারণে চাকরি হারানোর প্রক্রিয়া কীভাবে ঘটছে?

AI দুই ধরনের চাকরির ওপর প্রভাব ফেলছে:

সাদা কলারের চাকরি (White-collar jobs):

এগুলি হলো অফিস ভিত্তিক, মস্তিষ্কনির্ভর কাজ: যেমন অ্যাকাউন্টিং, লিগ্যাল অ্যাডভাইস, কনটেন্ট রাইটিং, কাস্টমার সার্ভিস, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি।

পূর্বে ভাবা হতো, এই ধরনের "জ্ঞানভিত্তিক" চাকরি AI সহজে নিতে পারবে না। কিন্তু এখন GPT, Copilot, Chatbot, Automated Legal Systems-এর মতো AI মডেলগুলো এই ধারণা ভেঙে দিচ্ছে।

ফলে উচ্চশিক্ষিত, স্যুট-বুট পরিহিত পেশাজীবীরা এক অজানা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।

নীল কলারের চাকরি (Blue-collar jobs):

যেমন কারখানার শ্রমিক, নির্মাণকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গাড়ি চালক ইত্যাদি। যদিও রোবোটিক্স ও অটোমেশন এখানে প্রভাব ফেলছে, তবুও অনেক কাজ এখনও শারীরিক উপস্থিতি ও নমনীয়তা দাবি করে, যা AI বা রোবটের জন্য কঠিন।

কেন সাদা কলারের চাকরি বেশি ঝুঁকিতে?

কারণ এগুলোর অনেক অংশ এখন ডেটা ভিত্তিক ও নিয়মভিত্তিক, যা AI খুব দক্ষতার সাথে অনুকরণ করতে পারে। AI প্রতিদিন "শিখছে" এবং "সংশোধন করছে", যেখানে মানুষের দক্ষতা শিখতে সময় লাগে। ফলে এই পেশাজীবীরা অনায়াসে প্রতিস্থাপনযোগ্য হয়ে পড়ছে।

কিন্তু AI-এর ইতিবাচক সম্ভাবনাও রয়েছে। ২০ শতকে একই প্রযুক্তি দিয়ে আমরা কমিউনিস্ট স্বৈরতন্ত্র এবং উদার গণতন্ত্র—দুই ধরনের সমাজই তৈরি করেছি।

AI-এর ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক পছন্দের সুযোগ রয়েছে, যদি আমরা মনে রাখি যে আমরা প্রথমবারের মতো যন্ত্রের সাথে নয়, স্বাধীন সত্তার সাথে কাজ করছি।

বিশ্বাসের সংকট এবং সমাধানের পথ

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখন সারা বিশ্বে বিশ্বাস ভেঙে পড়ছে—দেশগুলির মধ্যে এবং সমাজের ভেতরেও।

অনেকে আশা করছেন যে মানুষ যখন একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছে না, তখন AI আমাদের রক্ষা করবে। কিন্তু এটি সম্ভব নয়।

যে বিশ্বে মানুষ একে অপরের সাথে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং বিশ্বাস করতে পারে না, সেই বিশ্বের তৈরি AI-ও হবে প্রতিযোগিতামূলক এবং অবিশ্বস্ত।

মানুষ যখন নিজেরা হিংস্র প্রতিযোগিতায় জড়িত, তখন তারা কল্যাণকামী, বিশ্বস্ত AI তৈরি করতে পারে না।

ডিজিটাল অভিবাসন: নতুন এক চ্যালেঞ্জ

AI বিপ্লবকে আমরা লক্ষ লক্ষ ডিজিটাল অভিবাসীর ঢলের সাথে তুলনা করতে পারি। মানুষ অভিবাসীদের নিয়ে যে তিনটি প্রধান উদ্বেগ প্রকাশ করে—চাকরি নিয়ে নেওয়া, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল—AI অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা রয়েছে।

কিন্তু এই ডিজিটাল অভিবাসীদের ভিসার প্রয়োজন নেই, তারা রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে সমুদ্র পার হয় না। তারা আলোর গতিতে আসে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জানি না ভবিষ্যতে কী ঘটবে। আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের মানব সমাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু AI সমাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যখন লক্ষ লক্ষ AI একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করবে, তখন কী হবে তা আমরা জানি না।

এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামাজিক পরীক্ষা। আমরা সবাই এর অংশ, কিন্তু কেউই জানে না এটি কোথায় গিয়ে শেষ হবে।

তবুও আমাদের হাতে এখনও অনেক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা কীভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করব, সেই সিদ্ধান্ত এখনও আমাদের। প্রথমে আমাদের নিজেদের মধ্যকার বিশ্বাসের সংকট সমাধান করতে হবে, তবেই আমরা কল্যাণকামী AI তৈরি করতে পারব।

AI একটি শিশুর মতো—আমরা যেমন আচরণ করব, সে তেমনই শিখবে। তাই আমাদের নিজেদের আচরণ সংশোধনই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।