1 min read

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্ধকার অধ্যায় - ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণি, বিদ্রোহের আগুন

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্ধকার অধ্যায় - ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণি, বিদ্রোহের আগুন

শুরুতেই…

২০০১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের আকাশে যেন নতুন এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে- তবে এবার শত্রু বাইরের কেউ নয়, বরং চ্যালেঞ্জ এসেছে দেশের ভেতর থেকেই। একদিকে, সরকার ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’-এর মতো আধুনিকীকরণের স্বপ্ন আঁকে; অন্যদিকে, বারবার হোঁচট খায় পুরনো রোগে- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, আর অদৃশ্য অপারেশনাল ঘাটতি।

বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর এই উত্তাল যাত্রা মানে শুধু যুদ্ধবিমান বা টেকনোলজির গল্প নয়-এটা দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, এবং মানুষের সাহস-ভয়ের গল্পও।

এই প্রতিবেদন রচনা করতে গিয়ে আমি ডুবে গেছি সরকারি বিবৃতি, নামী পত্রিকা, আন্তর্জাতিক গবেষণা, এমনকি নানা অনলাইন ফোরামেও। কেননা, এই দুই দশকের গল্পটা শুধু মুখের কথা নয়- এটা এক বিস্তৃত, বহুস্তরের বাস্তবতা; যার মূল রঙ পাওয়া যায় বিভিন্ন দিকের তথ্য আর মতের ঠোকাঠুকিতে!


১৯৭৭ সালের বিমান বাহিনীর বিদ্রোহ!

১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিদ্রোহ কোনো সাধারণ বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল সরাসরি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা—যার সঙ্গে যুক্ত ছিল কেবল বিমান বাহিনী নয়, সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কর্পসের সদস্যরাও।

এই অস্থিরতার কেন্দ্রস্থলে ছিল এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ!


আনোয়ার সাদাতের সতর্কবার্তা: আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, রাষ্ট্রপতি জিয়া রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত- তিনি তখন মিশরের কায়রোয়, আনোয়ার সাদাতের সাথে। কিন্তু সেই বৈঠকে সাদাত তাঁকে এক ভয়াবহ বার্তা দেন-

মিশরীয় গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে জিয়াকে উৎখাত করে মার্কসবাদী সরকার বসানোর চক্রান্ত চলছে। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশি কিছু তালিকাভুক্ত সৈন্য ও নন-কমিশন্ড অফিসার, যাদের অনেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ।

সাদাত এমনকি এই ইঙ্গিতও দেন, চক্রান্তের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লিবিয়ার হাত থাকতে পারে! ষড়যন্ত্রকারীরা পরিকল্পনা করেছিলেন- ২৮ সেপ্টেম্বর বিমান বাহিনী দিবসে জিয়া ও শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা করবেন।

সেই খবর পেয়েই জিয়া ঢাকায় ফিরেই বিমানের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরে যেন একটি গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।


জাপান এয়ারলাইন্স ছিনতাই: আন্তর্জাতিক উত্তেজনার পটভূমি

এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক নাটকীয় ঘটনা- জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪৭২ অপহরণ।
প্যারিস থেকে টোকিওগামী এই বিমানটি মুম্বাই থেকে ছাড়ার পর, জাপানি লাল সেনা (জেআরএ) কমান্ডোরা অস্ত্র নিয়ে দখলে নেয় এবং ঢাকায় অবতরণে বাধ্য করে। তাদের দাবি ছিল, বন্দি সঙ্গীদের মুক্তি ও ৬ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ।

রাষ্ট্রপতি জিয়া এই সংকট মোকাবিলায় এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদকে দায়িত্ব দেন, যিনি ঘামঝরা মুহূর্তে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। এই উত্তেজনার মধ্যেই বাংলাদেশে শুরু হয় ভয়ংকর এক অভ্যুত্থানের নাটক।


বগুড়ায় প্রথম বিদ্রোহ

৩০ সেপ্টেম্বর, বগুড়া।
জাপান এয়ারলাইন্সের ছিনতাইয়ের আলোচনা চলাকালীন, বগুড়ায় বিদ্রোহ করে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু তালিকাভুক্ত সৈন্য।

তারা দুই লেফটেন্যান্টকে হত্যা করে, ব্রিগেড কমান্ডার ও অন্য অফিসারদের জিম্মি করে, ব্যাংক-দোকান লুটপাট চালায়, এবং আগের বছরকার (১৯৭৬) বিদ্রোহে দণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ জন সৈনিককে মুক্তি দেয়।

এই বিদ্রোহ আরও বড় আকার নিতে পারত—বিদ্রোহীরা ৪ হর্স নামের সাঁজোয়া ইউনিটকে পাশে টানার চেষ্টা করলেও, সফল হয়নি।


ঢাকায় চূড়ান্ত বিস্ফোরণ: রেডিও স্টেশন ও বিপ্লবী ঘোষণা

২ অক্টোবর, ভোর।

আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের শেখ আব্দুল লতিফ ব্যারাকে ‘ক্র্যাকার’ ছুঁড়ে সংকেত দেন- আর ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে শত শত সৈন্য।

অস্ত্রাগার লুট, কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি থেকে আরও বিমানসেনার যোগ, ৭০০ সৈন্য ও বিমানকর্মীর কেন্দ্রীয় অর্ডন্যান্স ডিপো আক্রমণ—সারাদেশ যেন মুহূর্তেই জ্বলতে শুরু করে।

পাঁচটার সময় দখল হয় সরকারি রেডিও স্টেশন। সেখানে বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট আফসার ঘোষণা দেন—

দেশে সশস্ত্র বিপ্লব হয়েছে, নতুন বিপ্লবী সরকার গঠন হয়েছে, আর তিনি এই বিপ্লব পরিষদের প্রধান। নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও সেই উত্তপ্ত সকালকে তুলে ধরে—“সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী ও ছাত্রদের সহায়তায় সফল বিপ্লব”।

বিমানবন্দর হত্যাকাণ্ড: রাত জাগা আতঙ্ক

অন্যদিকে, জাপান এয়ারলাইন্স ছিনতাইকারীদের নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকলেও, ঢাকার বিমানবন্দরে ঘটে যায় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড।

বিমান বাহিনীর বিদ্রোহী সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে বিএএফ-এর ১১ জন শীর্ষ কর্মকর্তা ও এক কর্মকর্তার ১৬ বছরের ছেলেকে। যারা পালাতে পেরেছিলেন, তারা বেসামরিক পোশাক পরে লুকিয়ে পড়েন; অন্যরা গুলিতে ঝরে পড়েন।

শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশন ও ৪৬তম ব্রিগেডের অভিযান, মেজর মোস্তফার নেতৃত্বে, বিদ্রোহী বিমানবন্দর পুরোপুরি দখলে নেয়। এতে ২০ জন বিমান বিদ্রোহী ও ১০ জন সেনাসদস্য নিহত হন, ৬০ জন বিদ্রোহী বন্দি হন।


বিদ্রোহ দমন ও শাস্তির মহোৎসব

বিদ্রোহীদের নেতা সার্জেন্ট আফসার পালাতে অস্বীকার করেন- তিনি বলেন, এত লোক তাঁর নামে অস্ত্র ধরেছে, পালালে সেটাই হবে বিশ্বাসঘাতকতা।

দুই অক্টোবর সকাল আটটার মধ্যে বিদ্রোহ কার্যত শেষ হয়ে যায়; জেআরএ ছিনতাইকারীরা তখন অধিকাংশ জিম্মিকে ছেড়ে দিয়ে ঢাকা ছেড়ে পালায়।

রাষ্ট্রপতি জিয়া রেডিও বার্তায় দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন, সবাই নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তিনি ঘোষণা দেন, কোনো দয়া নয়—শাস্তি হবে। এই সময় মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত তাঁকে অভিনন্দন জানান।

শাস্তি এতটাই কঠোর ছিল, সরকার দুইটি সেনা ইউনিট ও চারটি সিগন্যাল/সাপ্লাই ইউনিট ভেঙে দেয়, এমনকি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে পুরোপুরি গুটিয়ে এনে সেনাবাহিনীর অধীন করা নিয়ে চিন্তাও হয়েছিল—যা শেষ পর্যন্ত হয়নি।

সরকারি নথি অনুসারে, মাত্র দুই মাসে ১,১৪৩ জন সেনা ও বিমানকর্মীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আরও অনেকেই কারাদণ্ড পান। বিখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এই গণশাস্তিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে “সবচেয়ে নৃশংস, ধ্বংসাত্মক শাস্তির মহড়া” বলে মন্তব্য করেছেন—যা দ্রুততার সাথে, ন্যায়বিচার বা আইনি প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই চালানো হয়েছিল।


বিতর্ক, পক্ষ-বিপক্ষের মতামত

এই বিদ্রোহ ও দমন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।

অনেকেই মনে করেন, দেশের একত্রীকরণ, বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জিয়াউর রহমানের এই কঠোর পদক্ষেপ ছিল সময়োপযোগী। তাঁদের যুক্তি—বিদ্রোহ ছিল দেশবিরোধী, এতে বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানগুলোও সাধারণত এভাবেই দমন করা হয়েছে (সূত্র: Bangladesh Gazette, Stephen P. Cohen)।

বিপক্ষ যুক্তি হলো- এই গণগ্রেপ্তার, দ্রুত বিচার ও মৃত্যুদণ্ড আদতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনি প্রক্রিয়ার চরম ব্যত্যয় এবং পেশাগত নেতৃত্ব ধ্বংসের পথ খুলে দেয়। এতে “হারানো প্রজন্ম” তৈরি হয়—শত শত অভিজ্ঞ পাইলট, অফিসার হারিয়ে যায়, যা বিমান বাহিনীর দক্ষতা ও পেশাদারিত্বে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে (সূত্র: Amnesty International, Asia Watch, Sarmila Bose)।

অনেক ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যম পোস্টে দাবি করা হয়, “৬০০-র বেশি পাইলট ফাঁসিতে ঝুলেছেন”—তবে একাডেমিক গবেষণা ও রিপোর্টে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু ‘সদস্য’ বা ‘সেনাসদস্য’ লেখা আছে, পাইলট সংখ্যার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই (সূত্র: Reddit, The Wire)।

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তথা 'র'!


১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিদ্রোহে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW – Research and Analysis Wing)–এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা সময় নানা আলোচনা, গুজব, ও কিছু পর্যবেক্ষক-গবেষকের মতামত পাওয়া যায়। এখানে সংক্ষেপে বিষয়টি তুলে ধরা হল:

বাংলাদেশের সরকারি কোনো তদন্ত রিপোর্টে ১৯৭৭ বিদ্রোহে সরাসরি ‘র’ (RAW)-এর ভূমিকা নিয়ে নির্দিষ্ট, দালিলিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় না।

বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রধান সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার মূল কারণ হিসেবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ, রাজনৈতিক বৈরিতা, ও বাম-উগ্রপন্থী (জেএসডি, কমিউনিস্ট পার্টি) প্রভাবকেই গুরুত্ব দিয়েছে (সূত্র: Sarmila Bose, Amnesty International, Prothom Alo)।

তবে কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও কিছু ভারতবিরোধী লেখক দাবি করেছেন—বিদ্রোহের পেছনে ‘র’ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, যাতে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সরকার দুর্বল হয়, কিংবা নতুন বামপন্থী সরকার আসে।
তাদের যুক্তি ছিল, ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিশেষ করে বিমান বাহিনী দুর্বল থাকুক, যাতে দেশটি ভারতের কৌশলগত “নিয়ন্ত্রণ”–এ থাকে।

এই দিক থেকে, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতও জিয়াকে সতর্ক করেছিলেন সোভিয়েত ও লিবিয়া ছাড়াও ভারতের (পরোক্ষভাবে) ষড়যন্ত্র থাকতে পারে—এমনটা কিছু স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। তবে এটা যাচাইযোগ্য কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট নয়।

ভারতের RAW-কে ওই সময় বাংলাদেশে বহু ঘটনার “মূল হোতা” হিসেবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ১৯৭৭ বিদ্রোহে সরাসরি অর্থ বা অস্ত্র সহায়তা বা কোনো RAW-অপারেটিভের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা–এর প্রমাণ নেইআর প্রমাণ থাকার কথাও না!

আবার, খোদ ভারতীয় কিছু গবেষক স্বীকার করেন—

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যা, বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা কিংবা ৭৫-পরবর্তী অস্থিরতার সময়, ‘র’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে “নীরব” প্রভাব রেখেছে।

আমার মন্তব্য, 'র' এ ঘটনার সাথে জড়িত। কারণ বিমান বাহিনী'র বিদ্রোহের আদলে পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ঘটে যায় 'পিলখানা হত্যাকান্ড'। ১৯৭৭ সালে 'র' ব্যর্থ হয়েছিলো মূলত জিয়াউর রহমানের কারণে, কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা'র সহায়তায় 'পিলখানা হত্যাকান্ড' সফল!

১৯৭৭ সালের এই বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র আর শাস্তির ঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল একটি ঘটনা নয়—এটি আধুনিক বিএএফ-এর গভীর রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের সূচনা।

পরবর্তী অধ্যায়ে পড়ুন -

বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে F-7 ও আধুনিক যুদ্ধবিমান: সরকারের ভূমিকা, কেনার প্রেক্ষাপট ও বিতর্ক