বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (৩য় পর্ব): দশকের পর দশকের দুর্নীতি

স্বাধীনতার পর থেকে শত শত জীবন ও কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে চলা দুর্নীতি, নিরাপত্তা ব্যর্থতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) পরিকল্পিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে।
এই বিস্তৃত প্রতিবেদনটিতে ধামাচাপা, আর্থিক অনিয়ম এবং মারাত্মক অবহেলার একটি চাঞ্চল্যকর চিত্র উঠে এসেছে, যার পরিণতিতে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে; এতে ৩১ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৩৪ জনের মৃত্যু হয়।
১৯৭১ সাল থেকে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (BAF) অন্তত ২৫টিরও বেশি বড় বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে-
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ঘটেছে, এবং এই বৃদ্ধির হার যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
এই সময়ে, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর সামরিক কর্তৃপক্ষ সাধারণভাবে "যান্ত্রিক ত্রুটি"কেই দায়ী করেছে।
অথচ, বিপজ্জনক ট্র্যাক রেকর্ড সত্ত্বেও, তারা চীনা নির্মিত F-7 সিরিজের যুদ্ধবিমানগুলো পরিচালনা করা অব্যাহত রেখেছে।
বিমান বিশ্লেষকদের মতে, এসব বিমান আন্তর্জাতিক মহলে 'অবিশ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ' বলেই পরিচিত।
মাত্র এক দশকে F-7 বিমানগুলো অন্তত ৬টি বড় দুর্ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তবুও ২০২৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বিমান বাহিনী প্রায় ৪০টি এমন বিমান চালাচ্ছিল।
সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে ২১ জুলাই, ২০২৫ সালে। প্রথম একক ফ্লাইটে থাকা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের F-7BGI যুদ্ধবিমানটি ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হলে ৩১ জন ছাত্র ও ২ জন শিক্ষক নিহত হন।
বিমান বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম দীর্ঘদিন ধরেই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমানের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন, কিন্তু বিমান বাহিনী এসব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান প্রকাশ করেন যে,
বারবার দুর্ঘটনায় জড়ানো এই বিমানগুলোর ব্যবহার মূলত নিরাপত্তা বিবেচনায় নয়, বরং "অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা"র কারণে চালু রাখা হয়েছে
যা এক ভয়াবহ বার্তা দেয়: সামরিক বাহিনী মানুষের জীবনকে নয়, বরং খরচ বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ধামাচাপা দেওয়ার যন্ত্রটি কার্যকর
প্রতিটি ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে BAF-এর প্রতিক্রিয়া একটি পূর্বাভাসযোগ্য প্যাটার্ন অনুসরণ করে যা জবাবদিহিতা হ্রাস করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে:
- অভ্যন্তরীণ "উচ্চ-স্তরের কমিটি" গঠন করুন স্বাধীন তত্ত্বাবধান ছাড়াই
- সামরিক মুখপাত্র (ISPR) এর মাধ্যমে ন্যূনতম তথ্য প্রকাশ করুন
- বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছাড়াই সাধারণ "যান্ত্রিক ব্যর্থতা" কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করুন
- তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন না
- দুর্ঘটনাস্থল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে মিডিয়ার অ্যাক্সেস বন্ধ করুন
২০২৫ সালের স্কুল দুর্ঘটনার সময়, সামরিক কর্মীরা উদ্ধার অভিযানের সময় "শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে বাধা দিয়েছিলেন", যা শুরু থেকেই তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষার্থীরা যখন সঠিক হতাহতের সংখ্যা দাবি করে বিক্ষোভ করছিল, তখন প্রত্যক্ষদর্শী সানজিদা আক্তার স্মৃতি প্রতারণার কথা প্রকাশ করলেন:
"আমি ১০-১২ জনের বিকৃত মৃতদেহ দেখেছি। তারা কীভাবে বলতে পারে যে সেখানে মাত্র ২১ জন মারা গেছেন?"
দুর্নীতির সাম্রাজ্য: প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে ২৪৫ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে
শেখ আব্দুল হান্নানের বিশাল আত্মসাৎ প্রকল্প
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান, এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান—যিনি ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন—তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শুরু করা এক তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য:
হান্নান বিমান বাহিনীর বার্ষিক বাজেট থেকে প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন এবং সেই অর্থ পাচার করেছেন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
আদালতে উপস্থাপিত নথিতে তার অবৈধ কার্যক্রমের বিস্তৃতি আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে:
- মোট ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে, যেখানে পাওয়া গেছে ১.১৮ মিলিয়ন ডলার
- জব্দ করা হয়েছে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও একটি সাততলা ভবন
- হান্নান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে
- এছাড়াও, তার বিরুদ্ধে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ ও প্রভাব খাটানোর গুরুতর অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে
এই ঘটনা শুধু আর্থিক দুর্নীতির নয়—এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর আস্থার ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে।
মিগ-২৯ কেলেঙ্কারি: খোদ শেখ হাসিনাও এসব কেলেঙ্কারীতে জড়িত!
১৯৯৯ সালে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় নিয়ে বাংলাদেশে একটি বহুল আলোচিত দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে, যা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর একটি উদ্বেগজনক উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১২৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে ৪ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণ করেন।
দুর্নীতির মূল অভিযোগসমূহ:
- ব্যবসায়ী নূর আলী যুদ্ধবিমান ক্রয়চুক্তি থেকে ৪ মিলিয়ন ডলারের কমিশন পান।
- তিনি দাবি করেন, শেখ হাসিনাকে ১ কোটি টাকা এবং তার চাচাতো ভাইকে তিনটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট উপহার দেন।
- সজীব ওয়াজেদ জয় (শেখ হাসিনার পুত্র) - এর পক্ষেও সম্পত্তি উপহারের অভিযোগ রয়েছে।
- সাবেক এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদসহ একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে মামলার আওতায় আনা হলেও, ২০০৮ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০১০ সালে মামলাটি প্রত্যাহার করে দেওয়া হয়।
এই ঘটনাটি একটি গুরুতর দৃষ্টান্ত, যা দেখায়—রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার দাপট কীভাবে সামরিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির দায়মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।
পদ্ধতিগত প্রতিরক্ষা ক্রয় জালিয়াতি
দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিগত লেনদেনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্রয় ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগতভাবে বিদ্যমান। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরা হলো:
- ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রকল্প: যুদ্ধবিমানের জন্য ২.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দেওয়া হলেও প্রকল্পটি সীমিত স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত হয়েছে, যার ফলে বাজেট ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
- ২০১৭ সালের টেন্ডার বিতর্ক: বিরোধীদল অভিযোগ তোলে যে সরকার পুরনো ও অপ্রচলিত রাশিয়ান বিমান কেনার জন্য ভারতীয় ক্রেডিট লাইন ব্যবহার করছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
- মিগ-৩৫/এসইউ-৩০ ক্রয় বাতিল: ৪০০ মিলিয়ন ডলারের এই চুক্তি তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের অভিযোগের কারণে বাতিল হয়।
- দুর্বল নিরীক্ষা ও তদারকি ব্যবস্থা: প্রতিরক্ষা ব্যয় ও চুক্তিগুলোর ওপর পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় দুর্নীতি আরও সহজ হয়ে উঠেছে।
- সংসদীয় তদারকির বাইরের কর্মকাণ্ড: সামরিক খাতে অনেক ব্যয় এমনভাবে পরিচালিত হয় যা সংসদীয় পর্যবেক্ষণ ও স্বচ্ছতা কাঠামোর বাইরে রয়ে যায়, ফলে বাজেট-বহির্ভূত খরচের ঝুঁকি বাড়ে।
জবাবদিহির শূন্যতা: সামরিক বাহিনী কীভাবে তদারকি থেকে পালিয়ে যায়?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘গভর্নমেন্ট ডিফেন্স ইন্টিগ্রিটি ইনডেক্স’ অনুযায়ী
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা খাতে মাত্র ২৫/১০০ স্কোর পেয়েছে — যা "দুর্নীতির অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকি"-র ইঙ্গিত দেয়।
এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো
সামরিক কার্যক্রমে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের স্কোর ০/১০০, যেখানে বৈশ্বিক গড় মাত্র ১৬। এ থেকে স্পষ্ট, এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একেবারেই অনুপস্থিত।
প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এর কার্যকরতা নেই।
টিআই-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে,
"সেনাবাহিনীর বাজেট, ক্রয় সিদ্ধান্ত বা সামগ্রিক প্রতিরক্ষা নীতিতে সংসদের কার্যকর ভূমিকার খুব সামান্য প্রমাণই রয়েছে।"
এই সীমাবদ্ধতা পরিকল্পিতভাবেই তৈরি — কারণ
সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা খাতকে বেসামরিক তদারকির বাইরে রাখে, এবং "রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা"র অজুহাতে অতিরিক্ত গোপনীয়তা বজায় রাখে। যা দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য একধরনের কাঠামোগত রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে।
জনসাধারণের বিরুদ্ধে তথ্য যুদ্ধ
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ধারা রাখা হয়েছে যা সামরিক অভিযানের তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থেকে সেনাবাহিনীকে অব্যাহতি দেয়।
এই আইনের সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলের "অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩" একত্রে মিলে একটি তথ্য-অভেদ্য প্রাচীর তৈরি করেছে। যার আড়ালে সামরিক কার্যকলাপের নামে দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও মানবিক বিপর্যয় লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
২০২৫ সালের মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডির পর জনসাধারণ প্রথমবারের মতো জবাবদিহিতার দাবিতে সোচ্চার হয়।
কিন্তু হতাহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে চাওয়ার মতো একটি মৌলিক প্রশ্নের জবাব পেতেও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে নামতে হয়, কারণ সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে হতাহতের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশে গড়িমসি করে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের মৌলিক তথ্য গোপন রাখা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে।
তদন্ত থিয়েটার: সত্য নয়, আত্মরক্ষা
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (BAF) অভ্যন্তরীণ তদন্ত ব্যবস্থা মূলত সত্য উন্মোচনের জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানিক আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
এই ব্যবস্থার কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:
- কোনো স্বাধীন বেসামরিক তত্ত্বাবধান নেই- সামরিক তদন্তগুলি সম্পূর্ণরূপে সেনাবাহিনীর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
- কমিটিগুলো কেবল সামরিক সদস্যদের নিয়ে গঠিত, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত থাকা অস্বাভাবিক নয়।
- অনুসন্ধান ফলাফলের প্রকাশে কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই, ফলে বছর পার হলেও জনসাধারণ কোনো প্রতিবেদন পায় না।
- দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা না করে সাধারণভাবে "যান্ত্রিক ব্যর্থতা"কে দায়ী করা হয়, যা প্রকৃত দায় নিরূপণে ব্যর্থ।
- পুনরাবৃত্ত দুর্ঘটনার পরেও কোনো দৃশ্যমান পদ্ধতিগত নিরাপত্তা সংস্কার দেখা যায় না।
মিডিয়ার বিরুদ্ধে নীরবতা অভিযান: সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ
২০১৮ সাল থেকে সেনাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যুদ্ধ চালিয়েছে, যার মূল অস্ত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA)।
- এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৩৩৯টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই সামরিক দুর্নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা রিপোর্ট করার সাথে সম্পর্কিত।
- আইনটি এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে যাতে গভীর অনুসন্ধান বা সরকার ও সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি প্রকাশের সুযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
জুলকারনাইন সায়ের খানের মামলা: উদাহরণ ও প্রতিশোধ
আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত আল জাজিরা ডকুমেন্টারি “All the Prime Minister’s Men”-এ কাজ করার জন্য সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়।
এই অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভেতর দুর্নীতির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক উন্মোচিত হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে, তার ভাইকে ২০২৩ সালে প্রকাশ্যে লোহার রড দিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়।
নির্বাসন ও নির্যাতন: সত্য বলার মূল্য
সত্য বলার সাহস বাংলাদেশে শুধুই নৈতিক নয়, প্রায়শই জীবনবাজি রাখা একটি সিদ্ধান্ত।
সুইডেন-ভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রতিষ্ঠাতা তাসনিম খলিল ২০০৭ সালে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার হাতে নির্যাতনের শিকার হন এবং তার পরপরই নির্বাসনে বাধ্য হন।
তিনি সেনাবাহিনীর গোপন আটক কেন্দ্র ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাহসী অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। যা ছিল সে সময়ের একক ও সাহসী সাংবাদিক উদ্যোগ।
২০২৫ সালে, এই নিঃসঙ্গ সংগ্রামের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক "Shorenstein Journalism Award" লাভ করেন।
পুরস্কারটি তাকে নির্যাতন ও দমনমূলক পরিবেশে সত্য প্রকাশের অসামান্য সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে প্রদান করা হয়।
কিন্তু তাসনিমের গল্প শুধু একটি ব্যক্তির নয়- এটি গোটা জাতির তথ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কাহিনীও।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে নেত্র নিউজ ওয়েবসাইট পুরোপুরি অবরুদ্ধ।
এর ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও তথ্য থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
যেসব পুরস্কারপ্রাপ্ত তদন্ত সামরিক বাহিনী গোপন রাখতে চেয়েছিল
চরম নিপীড়ন ও আইনি হুমকির মধ্যেও কিছু সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক এমন সব তথ্য উন্মোচন করেছেন, যা সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে গোপন রাখতে চেয়েছিল।
আল জাজিরার বহুল আলোচিত অনুসন্ধান “All the Prime Minister’s Men” এই ধরনের একাধিক গুরুতর অভিযোগ উন্মোচন করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ইসরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তি অবৈধভাবে অধিগ্রহণ — জালিয়াতিপূর্ণ ক্রয় প্রকল্প ব্যবহার করে, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতির পরিপন্থী।
- হাঙ্গেরিয়ান ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে স্পাইওয়্যার কেনা, যাতে উৎস গোপন রাখা যায়।
- রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও অভিযান, যা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
- জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবস্থানকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ নজরদারি বৈধতা দেওয়া, যা আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটের চরম অপব্যবহার।
এই রিপোর্টটি "সেরা মানবাধিকার সাংবাদিকতা"-র জন্য Amnesty International Media Award জিতে নেয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে উচ্চ প্রশংসা পায়।
তবুও, বাংলাদেশে Digital Security Act-এর ভীতিকর বাস্তবতা এবং আইনি নিপীড়নের ঝুঁকির কারণে মূলধারার কোনো জাতীয় গণমাধ্যম এই অনুসন্ধানগুলো পুনঃপ্রকাশ বা আলোচনায় আনতে সাহস করেনি।
ফলে রাষ্ট্রীয় অপারেশনের অন্ধকার দিকগুলো সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক তুলনা
নিউজিল্যান্ড সামরিক অভিযানের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে ৭১/১০০ স্কোর করেছে - বাংলাদেশ ০/১০০ স্কোর করেছে। এই স্পষ্ট তুলনাটি প্রকাশ করে যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানের চেয়ে কতটা নিচে নেমে গেছে।
আধুনিক বিমান বাহিনী নিয়মিতভাবে বিমান তদন্ত বোর্ডের বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, নিরাপত্তার ঘটনা সম্পর্কে নিয়মিত সংসদীয় ব্রিফিং প্রদান করে এবং সামরিক বিমান চলাচলের স্বাধীন বেসামরিক তত্ত্বাবধান বজায় রাখে। বাংলাদেশ এই মৌলিক জবাবদিহিতা ব্যবস্থাগুলির কোনওটিই বাস্তবায়ন করেনি।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার মানবিক মূল্য
২০২৫ সালের জুলাইয়ের দুর্ঘটনাটি কয়েক দশকের অবহেলা এবং ধামাচাপা দেওয়ার চূড়ান্ত পরিণতি। ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও জনবহুল এলাকায় দুর্ঘটনাপ্রবণ বিমান পরিচালনা অব্যাহত রাখার কারণে ৩১ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী ২০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করে বীরত্বের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি প্রকাশ করে যে বছর কয়েক আগে কী বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল:
- পুরানো বিমান বাতিল করা
- প্রশিক্ষণ অঞ্চলগুলিকে জনবহুল এলাকা থেকে দূরে স্থানান্তর করা
- বিমান চালনা প্রোটোকলের নিরাপত্তা সংস্কার
- দুর্ঘটনার সঠিক প্রতিবেদন
- ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ
- দায়ী কর্মকর্তাদের জন্য শাস্তি
পাইলটদের মৃত্যুর ধরণ
২০০৮ সাল থেকে, চীনা বিমান দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জন বিমান বাহিনীর পাইলট নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে:
- স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান (২০০৮) - টাঙ্গাইলে F-7 দুর্ঘটনা
- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ (২০১৫) - বঙ্গোপসাগরে F-7MB দুর্ঘটনা
- উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু (২০১৮) - টাঙ্গাইলে F-7BG দুর্ঘটনা
- স্কোয়াড্রন লিডার অসীম জাওয়াদ (২০২৪) - YAK-130 দুর্ঘটনা
- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর (২০২৫) - F-7BGI দুর্ঘটনা
প্রতিটি মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেত যদি বিমানবাহিনী খরচ সাশ্রয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিত।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ও অবহেলার প্রকৃত পরিসর সম্পর্কে জনগণকে পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত করেছে।
এই প্যাটার্ন এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একেবারে সুসংগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ:
জানা বিপজ্জনক ট্র্যাক রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান পরিচালনার অব্যাহত সিদ্ধান্ত
জাতীয় প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ, জাতিকে রক্ষার নাম করে
আইনি হুমকি, মিডিয়া দমন এবং ডিজিটাল সেন্সরশিপের মাধ্যমে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ
সাংবাদিক, তথ্য ফাঁসকারী ও সমালোচকদের লক্ষ্যবস্তু করে ভয়ভীতি প্রদর্শন
দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনা ঘটলেও, কোনো অর্থবহ জবাবদিহিতা বা কাঠামোগত সংস্কারের প্রমাণ নেই
২০২৫ সালের মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের অবহেলা, পুঞ্জীভূত দুর্নীতি এবং পরিকল্পিত ধামাচাপার এক অনিবার্য ফলাফল। এতে প্রাণ হারান শিশু ও শিক্ষকরা। যাদের মৃত্যুর দায় অস্বীকার করা যায় না।
যতক্ষণ না বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রকৃত স্বাধীন তত্ত্বাবধান এবং কার্যকর জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের হাতে নিরীহ মানুষের মৃত্যু অব্যাহত থাকবে।
এই বাস্তবতা অস্বীকার করার আর সুযোগ নেই:
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এমন একটি ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যা একদিকে জনগণকে প্রতারিত করে, অন্যদিকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা ও পুরস্কৃত করে, এবং অযোগ্যতাকে কাঠামোগতভাবে আড়াল করে।
Member discussion