ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি: ২০২৪-২৫ এর টানাপোড়েন ও ভূরাজনৈতিক পালাবদল
শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে—দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা, নিষেধাজ্ঞা, চীন-ঘনিষ্ঠতা ও নির্বাচন ঘিরে পরিবর্তনের বিস্তৃত বিশ্লেষণ পড়ুন এখানে। জেনে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক যুদ্ধের কারণগুলো!

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস।
এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে তীব্র টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।
বিগত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে চুক্তি বাতিল, কূটনৈতিক উত্তেজনা, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য, সীমান্ত ও দূতাবাস কেন্দ্রিক ঘটনা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
প্রতিটি ঘটনাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। নিচে সময়ক্রম অনুযায়ী ওইসব মূল ঘটনাবলীর তারিখ, সংক্ষিপ্ত বিবরণ, প্রেক্ষাপট, বিশ্লেষণ এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তাদের প্রভাব উপস্থাপন করা হলো।
২০২৪ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ – বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সমতা ও ন্যায্যতার আহ্বান
২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস ঘোষণা করেন যে প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক “সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে” গড়ে ওঠা উচিত।
ঢাকায় ছাত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সাথে এক আলোচনায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তবে তা হতে হবে পারস্পরিক সম্মান ও সুবিচারের ভিত্তিতে।
প্রেক্ষাপট:
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হয়। ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় বাংলাদেশে তৎকালীন জনমনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ ও ক্ষোভ জন্মায়। ইউনুসের এই মন্তব্য নতুন সরকারের নীতির দিকনির্দেশক হিসেবে দেখা যায়, যা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার বার্তা দেয়।
বিশ্লেষণ:
ইউনুসের বক্তব্যে ইঙ্গিত ছিল যে পূর্ববর্তী সরকারের সময় ভারতের প্রতি যে একচেটিয়া ঝোঁক ছিল, তা সংশোধন করে বাংলাদেশ এখন ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক চায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষের প্রতিফলন, যারা মনে করে বিভিন্ন ইস্যুতে (যেমন সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি বণ্টন) ভারত ন্যায্য আচরণ করেনি।
প্রভাব: এই ঘোষণার মাধ্যমে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে শীতলতা বৃদ্ধি পায় এবং ভারতের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন যে নতুন সরকার আগের মত বিনা প্রতিবাদে ভারতের সব সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। তবে একইসঙ্গে এটি প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখারও আশ্বাস, যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথ খুলে রাখে।
নভেম্বর ২০২৪ শেষাংশ – বাংলাদেশে ভারতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ ও উত্তেজনা
২০২৪ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় জাতীয় পতাকা ও হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন ইস্কনের প্রতীক অবমাননার কিছু ঘটনা Reported হয়।
অভিযোগ ওঠে যে ঢাকার প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ঘটনা ঘটেছে।
প্রেক্ষাপট:
হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বিরোধী মনোভাব কিছু অংশে বেড়ে যায়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্নভাবে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার প্রতি ক্ষোভ এবং ভারতের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট কিছু গোষ্ঠী এ সময় জনসমক্ষে ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।
বিশ্লেষণ:
পতাকা অবমাননার মতো ঘটনা বাংলাদেশে বিরল এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এগুলো মূলত উগ্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও অস্বস্তিকর ছিল, কারণ এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করে।
সরকারিভাবে এ অভিযোগগুলোর সত্যতা পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
প্রভাব:
নভেম্বরে এই প্রতিবন্ধক ঘটনাগুলো পরবর্তীতে ভারতে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যত্রিপুরায় ক্ষুব্ধ হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠী এর জেরে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালায়, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে (বিস্তারিত পরের ঘটনায়)। দু’দেশের কর্তৃপক্ষকেও পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হতে হয়।
২ ডিসেম্বর ২০২৪ – ত্রিপুরায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে একদল উগ্রপন্থী হামলা চালায়।
হিন্দু সংগ্রর্ষ সমিতি নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা দূতাবাসের চত্বরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং ভবনের ভেতরে ভাঙচুর চালায়।
প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় পতাকা ও প্রতীক অবমাননার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ভারতীয় কট্টরপন্থীরা প্রতিশোধমূলকভাবে এই হামলা সংগঠিত করে। এটি ছিল উভয় দেশে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ক্রোধের চরম বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্লেষণ:
একটি কূটনৈতিক মিশনে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা তাৎক্ষণিকভাবে ভারত সরকারকে পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর করে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটিকে “চরম দুঃখজনক” বলে নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত অপরাধীদের শাস্তি দাবি করা হয়। পরদিনই (৩ ডিসেম্বর) ভারতীয় পুলিশ হামলায় জড়িত সাতজনকে গ্রেফতার করে এবং বাংলাদেশ মিশনসহ ভারতে বাংলাদেশের অন্যান্য দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর আশ্বাস দেয়।
প্রভাব:
এ ঘটনায় দু’দেশের সম্পর্কে মারাত্মক উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও, উভয় পক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে।
হামলার পর বাংলাদেশ সরকার দিল্লিতে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায়, আর ভারত সরকার দোষীদের গ্রেফতার ও নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে সম্পর্কের অবনতিকে সাময়িকভাবে থামাতে সক্ষম হয়।
তবু এই সহিংসতা দু’দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও ক্ষোভ বাড়িয়ে দেয় এবং বোঝা যায় যে সাম্প্রদায়িক বা জাতীয়তাবাদী উসকানির ঘটনা সম্পর্ককে দ্রুত অবনতি করতে পারে।
ডিসেম্বর ২০২৪ (শুরুর দিকে) – কূটনৈতিক তৎপরতায় উত্তেজনা প্রশমন
নভেম্বর-ডিসেম্বরের এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পর ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই উচ্চপর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিসরি ঢাকায় সফরে আসেন এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে বৈঠক করেন।
এই বৈঠকে দু’পক্ষ সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর ঘটনাবলী নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে এবং দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো সমাধানে “যৌথ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা” চালানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
মিসরি বিশেষ করে বাংলাদেশে হিন্দু, মন্দির ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং এগুলো রোধে পদক্ষেপ নিতে বলেন।
ইউনুস আশ্বস্ত করেন যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক “খুবই দৃঢ়” ভিত্তির ওপর স্থাপিত এবং সরকার সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
বিশ্লেষণ:
পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই জরুরি সফর ইঙ্গিত দেয় যে ভারত কূটনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে।
আলোচনায় দুই দেশ সম্পর্কের উপর “জমে থাকা মেঘ কাটিয়ে গঠনমূলক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার” আশা প্রকাশ করে।
২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাও এক বক্তব্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং “গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ” গড়ার পথে ভারতের দৃঢ় সমর্থন পুনর্নিশ্চিত করেন।
প্রভাব:
এই কূটনৈতিক তৎপরতা ডিসেম্বরের গুরুতর টানাপোড়েন অনেকটাই প্রশমিত করতে সাহায্য করে।
ভারত-বাংলাদেশ দু’পক্ষই বুঝতে পারে যে উত্তেজনা কমিয়ে আনা উভয়ের স্বার্থে জরুরি।
ফলস্বরূপ, বন্ধ হওয়া ভিসা কেন্দ্রগুলি ও কনস্যুলার কার্যক্রম পুনরায় সচল করার পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং সীমান্তে সতর্কতা বাড়ানো হয়।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালু থাকায় সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ – শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আবেদন
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কূটনৈতিক মীমাংসার পরও একটি বড় অনিষ্পন্ন বিষয় ছিল উৎখাত হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ।
হাসিনা আগস্টে ভারত আশ্রয় নেয়ার পর বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধেই গণহত্যা, খুনসহ নানাবিধ গুরুতর অভিযোগে মামলা চলে।
২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারকে শেখ হাসিনাকে “বিচারের স্বার্থে” ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে একটি কূটনৈতিক নোট ভার্বাল (লিখিত নোট) পাঠায়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান (এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) তৌহিদ হোসেন ঢাকায় সংবাদমাধ্যমকে জানান, “আমরা ভারতের কাছে নোট ভার্বাল পাঠিয়ে বলেছি বাংলাদেশ সরকার তাকে (হাসিনাকে) এখানে বিচার সম্মুখীন করতে চায়”।
ঢাকার এই উদ্যোগ আসে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফরের দুই সপ্তাহ পর এবং সম্পর্ক মেরামতের আশাবাদ ব্যক্ত করার পরপরই।
বিশ্লেষণ:
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গণআন্দোলনের প্রতিশ্রুতির অংশ এবং নিজেদের বৈধতা প্রমাণের একটি কৌশল হিসেবে দেখা যায়।
হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ক্ষোভ ছিল প্রচুর।
ইউনুস সরকার চেয়েছিল ভারতের সহায়তায় হাসিনাকে দেশে এনে এসব অভিযোগে বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করতে, যা তাদের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সাবেক সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
তবে ভারত এই আবেদনে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নোট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
দিল্লির দৃষ্টিকোণ থেকে, হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ছিল এক “মাথাব্যথা” – একদিকে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে আশ্রয় দেওয়া, অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন সরকারের চাপ।
প্রভাব:
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ অনুরোধ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য চাপ তৈরি করে।
দিল্লি এ অনুরোধ ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ঢাকার অসন্তোষ বাড়ায়। ভারতের “আনুকূল্য” নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে এমনিতেই প্রশ্ন ছিল; হাসিনাকে ফেরত না পাঠানোয় সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় এবং ভারত-বিরোধী অনুভূতি কিছুটা জোরদার হয়।
পরবর্তী মাসগুলোতে এই ইস্যুতে দিল্লি-ঢাকার মধ্যে একপ্রকার নীরব অচলাবস্থা বজায় থাকে এবং তা অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকেও ছায়া ফেলে।
১ জানুয়ারি ২০২৫ – বাংলাদেশের সামরিক ও কূটনৈতিক নেতৃত্বের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের অঙ্গীকার
২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক নেতৃত্ব ভারতকে আশ্বস্ত করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে।
নববর্ষের দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি পত্রিকাগত সাক্ষাৎকারে বলেন,
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক “দ্বিপক্ষীয় নির্ভরশীলতার” সম্পর্ক এবং উভয় দেশই পরস্পরের উন্নয়ন ও কল্যাণে ভূমিকা রাখে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ কখনো এমন কিছু করবে না যা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী হয়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশও প্রত্যাশা করে যে ভারত তার প্রতি কর্তৃত্ববাদী মনোভাব পোষণ করবে না এবং ন্যায্য আচরণ করবে।
একই দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন জানান, ২০২৫ সালে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে এবং কোনো একটি ইস্যুতে দুই দেশের বন্ধুত্ব ভঙ্গ হবে না।
বিশ্লেষণ:
বছরের শুরুতেই এসব বক্তব্য দেওয়ার লক্ষ্য ছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা রক্ষা। হাসিনা যুগের অবসানে ভারত শুরুতে শঙ্কিত ছিল যে নতুন সরকার পুরোপুরি ভারত-বিরোধী দিকে চলে যাবে।
সেনাপ্রধান ও সরকারের আশ্বাসমূলক কথাবার্তা ভারতের সেই আশঙ্কা কিছুটা দূর করে।
বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতকে স্পষ্ট জানায় যে বাংলাদেশ “ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্মানের” সম্পর্ক চায়, যেখানে একদেশ অপরকে আধিপত্য করবে না।
এটা উল্লেখযোগ্য যে এর আগে অনেক সময়েই বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব ভারত সম্পর্কে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল।
ইউনুস সরকারের অধীনেও তাই ঘটেছে –
তারা একদিকে জনগণের India-বিদ্বেষী আবেগকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, অন্যদিকে বাস্তবতা অনুযায়ী প্রতিবেশী শক্তির সাথে সদ্ভাব রাখতে চায়।
প্রভাব: এই প্রতিশ্রুতিমূলক বার্তাগুলো ভারতকে কিছুটা নিশ্চিন্ত করে যে সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হবে না। বছর শুরুর ইতিবাচক সুর দু’দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে।
ফলস্বরূপ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়মিত ইস্যুগুলো নিয়ে কর্মপর্যায়ে আলোচনা থেমে যায়নি বরং এগিয়ে চলে (যেমন পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সম্মেলন ইত্যাদি)।
ভারতের পক্ষ থেকেও নতুন সরকারের সাথে কার্যকরী সম্পর্ক রাখতে উৎসাহ দেখা যায়।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ – সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক ও সীমান্ত ইস্যু সমাধানের চেষ্টা
২০২৫ সালের ১৭-২০ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর মহাপরিচালক (ডিজি) পর্যায়ে চারদিনব্যাপী একটি সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি যৌথ আলোচনার শেষ দিন দুই দেশের সীমান্ত বাহিনী একটি "যৌথ আলোচনার রেকর্ড" নথিতে স্বাক্ষর করে।
আলোচ্যসূচি:
এই বৈঠকে বহুদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যাগুলো গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে সীমান্তে গুলি করে হত্যা ও প্রাণহানি কমানো, অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্ঘন রোধ এবং সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (CBMP) জোরদার করার বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ বিশেষভাবে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা তুলে ধরে এবং এ বিষয়ে শূন্য সহনশীলতা নীতির দাবি জানায়।
অন্যদিকে ভারত সীমান্তে বেআইনি অনুপ্রবেশ, গরু ও মাদক পাচার এবং সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে নির্মাণকাজের বিষয়গুলো সামনে আনে।
বিশ্লেষণ:
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সীমান্ত বাহিনীর এই নিয়মিত বৈঠক দু’দেশের কার্যকর সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোর একটিতে স্থিরতা বজায় রাখে।
এটা স্পষ্ট হয় যে ভৌগোলিক সীমান্ত সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মেটাতে মাঠপর্যায়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া অপরিহার্য, যেটা কেবল কূটনৈতিক পর্যায় থেকে সম্ভব নয়।
সীমান্ত সম্মেলনে পানিবণ্টন বা দূরপাল্লার ইস্যু আলোচিত না হলেও, স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো (যেমন ত্রিপুরার আগরতলা শহরের পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পানি শোধনাগার স্থাপন ইত্যাদি) নিয়ে আলাপ হয়।
উভয় পক্ষ সম্মত হয় যে বিদ্যমান সমন্বয় ব্যবস্থা (Joint Border Management Plan) শক্তিশালী করা হবে এবং আস্থাবর্ধক পদক্ষেপ (Confidence Building Measures) নেওয়া হবে যাতে সীমান্ত সংঘাত কমে।
প্রভাব: সীমান্ত বাহিনীর এই আলোচনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি ইতিবাচক সুর বজায় রাখে, যখন উপরের স্তরে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে।
ফেব্রুয়ারির এই বৈঠকের ফলে দু’দেশ সীমান্তে টহল জোরদার, তথ্য বিনিময় বাড়ানো এবং ভুল-বোঝাবুঝি হলে হটলাইন ব্যবহার বাড়ানোর মতো কিছু পদক্ষেপে ঐকমত্যে পৌঁছায়।
যদিও সীমান্তে সব সমস্যা রাতারাতি মেটেনি, তবু নিরাপত্তা সহযোগিতার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির মধ্যেও পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলোতে দুই দেশ কাজ করতে প্রস্তুত।
২৮ মার্চ ২০২৫ – ইউনুসের চীন সফর, তিস্তা প্রকল্পে চীনা অংশগ্রহণ ও নতুন জোট
২০২৫ সালের মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস চীনে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যান।
২৮ মার্চ বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠকে ইউনুস সরকার একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয় – তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনর্খনন প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়।
তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এক স্পর্শকাতর বিষয় ছিল; এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে রেখেছে, পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে কোনো সুরাহা হয়নি।
ইউনুসের সরকারের এই পদক্ষেপে চীনকে সরাসরি প্রকল্পে এনে ভারতকে পাশ কাটানো হলো।
একই বৈঠকে ঢাকা ও বেইজিং আরও বেশ কিছু চুক্তি সই করে এবং মোট ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি আদান-প্রদান হয়।
যৌথ ঘোষণায় দুই দেশ নদীর পানিবণ্টন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা বাড়ানোর কথাও জানায়।
বাংলাদেশের পক্ষে ইউনুস “এক-চীন নীতি” জোরালোভাবে পুনর্নিশ্চিত করে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন, যা চীনা নেতৃত্ব প্রশংসার সাথে গ্রহণ করে।
বিশ্লেষণ:
এই সফর ছিল ইউনুস সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মোড় পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
শেখ হাসিনার আমলেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল, তবে হাসিনা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন যাতে ভারত আহত না হয়।
বিপরীতে, ইউনুস খোলাখুলিভাবে প্রমাণ করেন যে তাঁর সরকার চীনের দিকে ঝুঁকতে দ্বিধা করছে না।
বেইজিংয়ে তিনি বলেন,
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আসলে “সাগরবিহীন ভূমি, যার সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার নেই” এবং বাংলাদেশ এই অঞ্চলে সমুদ্রের অভিভাবক।
India's North East Has No Sea Access, Bangladesh Is Guardian Of Sea
এই মন্তব্য ভারত খুবই নেতিবাচকভাবে নেয় এবং আঞ্চলিক সংযোগে বাংলাদেশকে চীনের প্রসার ঘটানোর হুমকি হিসেবে দেখে।
তিস্তা প্রকল্পে চীনা অংশগ্রহণের আমন্ত্রণকে ভারতের প্রতি “নীতিগত চ্যালেঞ্জ” হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কেননা দীর্ঘদিন ধরে ভারত ওই প্রকল্পে শামিল হতে চাইছিল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে সফল হয়নি।
এছাড়া প্রতিরক্ষা খাতেও ঢাকা-বেইজিং ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত মেলে – ইউনুসের সফরে চীনের সাথে সম্ভাব্য J-10C যুদ্ধবিমান ক্রয় ও সামরিক সহযোগিতার কথাও আলোচনায় আসে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রভাব:
ইউনুসের চীন সফরের পর দিল্লি-ঢাকার সম্পর্কে নতুন করে অবিশ্বাসের প্রাচীর দাঁড়ায়।
ভারত মনে করে বাংলাদেশ এখন তাদের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের পক্ষে স্পষ্ট পক্ষপাত দেখাচ্ছে, যা আঞ্চলিক ভারসাম্য তার বিপক্ষে নিয়ে যেতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া দ্রুত দেখা যায় –
বাংলাদেশ সরকার চীন থেকে ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই ভারত কিছু কড়া বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত করে (যা পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হয়েছে)।
তবু বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও কূটনৈতিক স্বার্থে বিকল্প জোট গড়ার মাধ্যমে ভারতকে বার্তা দেয় যে ঢাকা এককভাবে দিল্লির উপর নির্ভরশীল নয়।
৪ এপ্রিল ২০২৫ – বিমসটেক সম্মেলনে ইউনুস-মোদি সাক্ষাৎ ও সম্পর্কের বরফ গলানোর চেষ্টা
দীর্ঘ বিরতির পর ২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ বিমসটেক (BIMSTEC) শীর্ষ সম্মেলনের পার্শ্বলাইনে বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব মুখোমুখি বসেন।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এটাই ছিল আগস্ট ২০২৪-এ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।
বৈঠকে উভয় নেতা আলোচনার মাধ্যমে নানা বিষয়ে মতবিনিময় করেন।
আলোচ্য বিষয়:
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় প্রধান ছিল শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের প্রসঙ্গ, যা ইউনুস সরাসরি মোদির কাছে তোলেন বলে কর্মকর্তারা জানান।
এছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ড বন্ধ, গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও সুরক্ষা এবং সাম্প্রতিককালে দু’দেশের নেতাদের বিপক্ষেও যেসব উত্তেজনামূলক বক্তব্য এসেছে সেগুলো নিয়ে কথা হয়।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও সকল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার ওপর জোর দেন এবং বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক, স্থির, শান্তিপূর্ণ ও অগ্রসর জাতি গঠনে ভারতের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
ইউনুসও ফোনালাপে মোদিকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে।
সরাসরি আলোচনায় এই বিষয়গুলিতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়াতে সম্মতি প্রকাশ করা হয়।
ইউনুস বৈঠকের শেষে মোদিকে ২০১৫ সালে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসে মোদির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের একটি ফটো স্মারক হিসেবে উপহার দেন, যা ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের বার্তা বহন করে।
বিএনপি’র মতো বাংলাদেশের বড় বিরোধী দল ইউনুস-মোদি বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে একে “আশার আলো” বলে অভিহিত করে, যা বৈরী সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বলে ইঙ্গিত বহন করে।
বিশ্লেষণ:
এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়া নিজেই ছিল সফলতা, কারণ আগের কয়েক মাসে সম্পর্ক এতটাই তলানিতে ছিল যে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন মোদি-ইউনুস মুখ দেখাদেখিও নাও করতে পারেন।
বৈঠকে যে সব স্পর্শকাতর ইস্যু খোলামেলা আলোচিত হয়েছে – বিশেষত হাসিনা প্রত্যর্পণ, নদীর পানি ও সীমান্ত হত্যা –
তা দেখায় দুই পক্ষই সমস্যা অস্বীকার না করে সমাধানের পথে হাঁটতে চায়। এমনকি মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও আগেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, ফলে ইউনুস সরকারও এই ইস্যুতে সক্রিয় পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেয়।
মোদি-ইউনুস বৈঠকে সুর কিছুটা ইতিবাচক থাকলেও পর্দার আড়ালে ভারতের অসন্তোষ ছিল –
বিশেষত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চীনঘনিষ্ঠতা ও হাসিনার ব্যাপারে ভারতের অনিচ্ছা।
বৈঠকের মাত্র তিন দিন আগে ইউনুস বেইজিং সফর থেকে বড় চীনা বিনিয়োগ নিয়ে ফিরেছেন, তাই দিল্লি কিছুটা চাপ তৈরির কৌশল নিতে থাকে।
প্রভাব:
প্রকাশ্যে বৈঠককে “গঠনমূলক, ফলপ্রসূ ও কার্যকর” বলা হয় এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করে একে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মোড় হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
বৈঠকের পরপরই ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন ইস্যুগুলোতে সচেতনভাবে কাজ করার কথাও জানায়।
তবে..................
পর্দার অন্তরালে এই সাক্ষাতের পর ভারত দ্রুত কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার ইঙ্গিত মেলে বৈঠকের তিন দিনের মাথায় (৭ এপ্রিল)
একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহার ও মে মাসে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে।
তা সত্ত্বেও এপ্রিলের এই শীর্ষ বৈঠক দু’দেশের মধ্যে উচ্চস্তরে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে, যা সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া থেকে বিরত রাখে।
৭ এপ্রিল ২০২৫ – ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার: বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা
ব্যাংককে মোদি-ইউনুস সাক্ষাতের মাত্র তিন দিন পর, ২০২৫ সালের ৭ এপ্রিল ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিল করে দেয়।
২০২০ সালে ভারতের শুল্ক কর্তৃপক্ষ যে নির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রফতানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছিল, এপ্রিল ২০২৫-এ তা ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইন্ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস-এর নতুন বিজ্ঞপ্তিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হয়।
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ আর ভারতে ট্রানজিট নিয়ে নেপাল, ভুটান বা অন্য তৃতীয় দেশে সহজে পণ্য পাঠাতে পারবে না।
প্রেক্ষাপট:
ইউনুসের চীন সফর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত সম্পর্কে তার সাহসী এবং বিতর্কিত মন্তব্যের জের ধরেই দিল্লি এই পদক্ষেপ নেয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ভারত সরকারের মতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নেতা যখন প্রকাশ্যে ভারতের উত্তর-পূর্বকে “সমুদ্রপথে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড” বলে চিহ্নিত করে চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের কথা বলছেন, তখন ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া বিশেষ বাণিজ্য সুবিধাগুলো পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য।
বিশ্লেষণ:
হঠাৎ করে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তীব্র সংকেত দেয়।
এটি বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে আঘাত-এর মত, কারণ
বাংলাদেশের অনেক রফতানি পণ্য (বিশেষত ভূটান ও নেপালের উদ্দেশ্যে) ভারতে ট্রানজিট নিয়ে যাতায়াত করত।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত ঢাকাকে চাপের মুখে ফেলে এবং ভারতের উপর নির্ভরশীল রফতানি পথের ঝুঁকি স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভারত স্পষ্টভাবেই বোঝাতে চেয়েছে যে তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষা করে চীনের দিকে ঝোঁকার ফল সহজ হবে না।
প্রভাব:
এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টাইট-ফর-ট্যাট (প্রতিশোধমূলক) বাণিজ্য যুদ্ধের শুরু হয়।
ঢাকা প্রকাশ্যে এ পদক্ষেপের সমালোচনা না করলেও, পরবর্তীতে বাংলাদেশের নেয়া কিছু পদক্ষেপ থেকে প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয় (যেমন ভারতীয় পণ্যে বিধিনিষেধ আরোপ)।
এই সময় থেকে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিনের মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগগুলো সীমিত হতে থাকে।
তবে ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা হারানোর ফলে বাংলাদেশ বিকল্প পথ (সমুদ্রপথে সরাসরি তৃতীয় দেশে রফতানি বাড়ানো) খুঁজতে শুরু করে, যা আংশিকভাবে ভারতের প্রভাব কমানোর কৌশলও বটে।
এপ্রিল ২০২৫ – বাংলাদেশের ভারতীয় পণ্যে বিধিনিষেধ ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই একে অন্যের বাণিজ্যপণ্যের ওপর ক্রমশ বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তোলে।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের আগে থেকেই ঢাকা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল (যদিও কার্যকর হয় ভারতের ট্রানশিপমেন্ট বাতিল করার পরে) –
২০২৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ভারত থেকে আসা সুতা (ইয়ার্ন) আমদানি প্রধান স্থলবন্দরগুলো দিয়ে বন্ধ করে দেয় এবং চিনি, চালের মতো কিছু পণ্যের আমদানিতেও কড়াকড়ি আরোপ করে।
একই সাথে কাগজ, তামাক, মাছ ও গুঁড়োদুধের মতো একাধিক ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ বা সীমিত ঘোষণা করা হয়।
এসব পদক্ষেপের পেছনে ঢাকা যুক্তি দেখায় যে স্থানীয় শিল্প ও উৎপাদন সুরক্ষার জন্য এবং আমদানি ব্যাল্যান্স রক্ষার জন্য এগুলো জরুরি।
তাছাড়া বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে ভারত যে পণ্য ট্রানজিট করে (বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন), এপ্রিল থেকে সেসবের ওপর প্রতি টন প্রতি কিলোমিটারে ১.৮ টাকা হারে একটি ট্রানজিট ফি ধার্য করা হয়।
বাংলাদেশের এসব পদক্ষেপকে দিল্লি শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে দেখতে থাকে এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এপ্রিলের শেষ নাগাদ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত কিছু উল্লেখযোগ্য পণ্যকে সীমিত করা হবে।
বিশ্লেষণ:
বাংলাদেশের অর্থনীতি বহু Indian পণ্যের উপর নির্ভরশীল হলেও, অন্তর্বর্তী সরকার ওই সময় কিছুটা জাতীয়তাবাদী অবস্থান নেয় দেশের শিল্পোদ্যোগীদের সন্তুষ্ট করতে ও ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে।
ভারতীয় তুলা ও সুতা কম্পোনেন্ট বাংলাদেশের বিশাল পোশাকশিল্পের কাঁচামাল; এই পথে বাধা দিয়ে ঢাকা দেখায় যে প্রয়োজনে সে ভারতের বিকল্প উৎস খুঁজবে বা নিজস্ব উৎপাদনে জোর দেবে। অন্যদিকে ভারত এটাকে ভালো চোখে নেয়নি।
দিল্লির মতে,
“বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের শর্তগুলো নিজ স্বার্থে একতরফাভাবে নিজের মতো সাজাচ্ছে” এবং এটা মেনে নেওয়া হবে না।
এর প্রতিক্রিয়ায় তারা ঠিক করে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাকশিল্পকে আঘাত করার জন্য স্থলপথে এ পণ্য প্রবেশে বাধা দেবে।
প্রভাব:
এপ্রিল জুড়ে চলা এই বাণিজ্যিক চাপাধাপি মে মাসে গিয়ে উন্মুক্ত সংঘাতে রূপ নেয় (যা পরবর্তী ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে)।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব পণ্য নির্বিঘ্নে আদান-প্রদান হতো, তার প্রায় ৪২% এর ওপর এই সময় নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা আসে।
দুই দেশের ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা এর কুফল ভোগ করতে শুরু করে –
ভারতে বাংলাদেশের কাপড় ও খাদ্যপণ্য কম পৌঁছাতে থাকে, আর বাংলাদেশে ভারতীয় কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
এর ফলে দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন অর্থনীতিতেও স্পষ্ট হয়ে পড়ে।
১০ মে ২০২৫ – আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ: অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর পদক্ষেপ
২০২৫ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সরকার এক রূঢ় সিদ্ধান্তে দেশটির অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা সেদিন রাতেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগকে “ভয়াবহ নিরাপত্তা ঝুঁকি” হিসেবে চিহ্নিত করে সকল কর্মকাণ্ডে স্থগিতাদেশ জারি করে বলে আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদমাধ্যমকে জানান।
সরকারের বিবৃতিতে জানানো হয় যে আওয়ামী লীগ ও তার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যেহেতু বিশেষ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে- আন্দোলনে শত শত বিক্ষোভকারীর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২৪ সালের অক্টোবরেই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার দায়ে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
১০ মে সন্ধ্যায় ঢাকার শাহবাগে সহস্রাধিক আন্দোলনকারী রাস্তায় অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগান দেয় এবং সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর উল্লাস প্রকাশ করে।
বিশ্লেষণ:
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের এই পদক্ষেপ আধুনিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভূতপূর্ব।
১৫ বছর দেশের ক্ষমতায় থাকা দলটিকে হঠাৎ “সন্ত্রাসী” তকমা দিয়ে নিষিদ্ধকরণে অভ্যন্তরীণভাবে ইউনুস সরকার তার কঠোর মনোভাব ও চলমান বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি পূরণের ইঙ্গিত দেয়।
সমর্থকরা এটিকে ন্যায়বিচারের পথে পদক্ষেপ বলে দেখালেও বিরোধী পক্ষ – বিশেষ করে আওয়ামী লীগ – এ সিদ্ধান্তকে “অবৈধ সরকারের অবৈধ কাজ” বলে তীব্র নিন্দা জানায়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ফেব্রুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে প্রায় ১,৪০০ লোক নিহত হয়েছে; ইউনুস সরকার এই ভয়াবহতার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে জনমতকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা করেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ সতর্ক করেন যে “অপরাধের বদলে রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য পুরো দলকে শাস্তি দেয়া” বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
বিরোধী বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো সাময়িকভাবে এই পদক্ষেপকে সমর্থন করলেও (কারণ তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিটকে গেল), দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য দুর্বিপাক আনতে পারে।
প্রভাব:
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে সবচেয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া আসে ভারত ও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে।
ভারত বহু বছর ধরেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখে আসছিল।
ফলে দলটি নির্বাচনের বাইরে চলে যাওয়া দিল্লিকে চিন্তিত করে যে বাংলাদেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
ভারত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও সর্বসম্মত নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
[Note: এই ঘটনা মনে রাখবেন বিশেষ করে যে পরিস্থিতিতে আর সময়ে ঘটে। তা হলে রসুনের কোয়া গুলো গুলোর গো* কোথায় তা বুঝতে সহজ হবে।]
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও জানায় তারা এই নিষেধাজ্ঞার খবর জানে এবং বাংলাদেশে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
আন্তর্জাতিক মহলে ইউনুস সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকেই ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে, যদিও সরকার বলছে এটা গণহত্যার বিচারের স্বার্থে করা হয়েছে।
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কঠোর বিবৃতি না দিলেও,
পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেন “সম্ভাব্য সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে” হয়, সেই দাবী জোরালোভাবে তোলে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বাভাবিক রাজনৈতিক চ্যানেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় –
দিল্লির সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা দলটি মাঠের বাইরে চলে যাওয়ায় ভারতের নীতি-সংলাপের অংশীদার সীমিত হয়ে পড়ে।
দীর্ঘমেয়াদে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে যে নির্বাচন হবে তা নিয়ে ভারতসহ অনেক দেশের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয় এবং তারা নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে – যা বাংলাদেশ-ভারত ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
১৩ মে ২০২৫ – নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত ও নির্বাচনী রাজনীতি থেকে বহিষ্কার
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সরকারি ঘোষণার অব্যবহিত পর (১০ মে’র মধ্যে) বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দলটির নির্বাচনী নিবন্ধন স্থগিত করে।
১৩ মে নির্বাচন কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আওয়ামী লীগের সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে এবং দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায়,
তাই আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করা হল – পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে দলটি অংশ নিতে পারবে না।
ইসি’র সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন,
“আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সকল কার্যক্রম স্থগিত থাকায় কমিশন দলটির নিবন্ধন সাময়িক বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে,
নিবন্ধিত না থাকলে কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না
তাই এই পদক্ষেপ আওয়ামী লীগকে কার্যত রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করল।
বিশ্লেষণ:
নির্বাচন কমিশন সরকারঘনিষ্ঠ অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে।
সরকারের দৃষ্টিতে,
আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত “অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের” বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে ফিরতে না দেওয়া ন্যায়সংগত।
ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে,
এই পদক্ষেপ তাদের দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক বিনিয়োগের ওপর আঘাত।
দিল্লি সব সরকারসহ কাজ করতে চাইলেও আওয়ামী লীগের মতো প্রো-ইন্ডিয়া দল রাজনীতির বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশে ভারতপন্থী ধারাটিই দুর্বল হবে।
প্রভাব:
নির্বাচন কমিশনের এই ঘোষণা আসার পর দিল্লিতে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে যে বাংলাদেশে সম্ভাব্য একদলীয় নির্বাচন বা বিতর্কিত ভোট হতে যাচ্ছে, যা জনগণের সমর্থন পাবে না।
এসময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চাপ বাড়তে থাকে যেন আওয়ামী লীগসহ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরিয়ে জানায় যে তারা বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায় যেখানে সব বড় রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভারসাম্য পরিবর্তনের আশঙ্কায় ভারত বিকল্প যোগাযোগ চ্যানেল খোঁজা শুরু করে –
বিএনপি ও অন্যান্য দলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা দেখা যায় – যাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার যে-ই আসুক, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী থাকে।
সব মিলিয়ে, আওয়ামী লীগকে মাঠছাড়া করার ঘটনাপ্রবাহ ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ভরকেন্দ্রটি নড়বড়ে করে দেয় এবং দুই দেশের পারস্পরিক কৌশল ও আস্থার ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
১৮ মে ২০২৫ – ভারতের স্থলবন্দরে বাংলাদেশি পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা: বাণিজ্য সংঘাতের চূড়ান্ত রূপ
মে ২০২৫-এর মাঝামাঝি এসে বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে চলমান বাণিজ্য সংঘাত সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়।
১৮ মে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে
বাংলাদেশ থেকে প্রস্তুতকৃত পোশাকসহ বেশ কিছু ভোগ্য ও শিল্প পণ্য আর কোন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না।
ভারতীয় বাণিজ্য অধিদপ্তরের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়,
এখন থেকে বাংলাদেশের কাপড়-দর্জি করা তৈরি পোশাক (RMG) কেবল কলকাতা বা নবাসেবা (মুম্বাই) সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে; উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে সংযোগকারী ১১টি স্থলবন্দর পথে এসব পণ্য প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হল। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী, কোমল পানীয়, কাঠের ফার্নিচার, ফলের জুস ও কার্বোনেটেড ড্রিংকস, তুলা-বর্জ্যসহ অন্যান্য বহু পণ্যের স্থলপথে আগমন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
প্রেক্ষাপট:
ভারত এই পদক্ষেপ স্পষ্টত বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক ভারত-বিরোধী বাণিজ্যনীতির পাল্টা জবাব হিসেবে গ্রহণ করে।
“ঘনিষ্ঠ সূত্র”-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জানায় যে “প্রতিবেশী দেশটির আরোপিত বিধিনিষেধের জবাবে” এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
কারণ এর ঠিক এক মাস আগে ভারত বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধ করে এবং তারও আগে বাংলাদেশ ভারত থেকে একাধিক পণ্যে বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করে (যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে)।
ভারতের পর্যালোচনায় উঠে আসে যে বাংলাদেশের ধারাবাহিক বাধাসৃষ্টিকারী পদক্ষেপে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর অর্থনীতি ও ভারতীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল,
তাই ভারতও বাংলাদেশকে তার বড় রপ্তানি আয়ের খাতগুলিতে আঘাত করতে চায়।
বাংলাদেশের $৭০০ মিলিয়ন মূল্যের বার্ষিক রেডিমেড পোশাক রফতানির ৯৩% স্থলপথে ভারতে আসত, সুতরাং এই পথে নিষেধাজ্ঞা তাদের পোশাক খাতে বড় ধাক্কা দেবে বলে ধারনা করা হয়।
বিশ্লেষণ:
ভারতের এ পদক্ষেপ দু’দেশের দ্বন্দ্বকে বাণিজ্য যুদ্ধের সর্বাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়।
উভয় দেশই পরস্পরের প্রায় অর্ধেক আমদানি-রফতানিকে সীমাবদ্ধ বা ব্যাহত করছে এই সময়কালে।
ভারত এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের চাপের মুখে ফেলতে চেয়েছে যাতে ঢাকা তার চীনঘনিষ্ঠ ও ভারত-বিরোধী নীতি থেকে সরে আসে।
বাস্তবে দেখা যায়, স্থলপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করেন, যা খরচ ও সময় দুই-ই বেশি লাগে।
অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বের বাজারগুলো বাংলাদেশি পণ্যের অভাবে কিছুটা ব্যয়বহুল বিকল্পের দিকে যেতে থাকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার বার্তা দেয় যে
“বাংলাদেশ কেবল নিজের সুবিধামতো সমীকরণ সাজাতে পারবে না, ভারতীয় বাজারকে গুরুত্ব দিতেই হবে”।
একই সাথে তারা উল্লেখ করে সমস্যার সমাধানে আলোচনা উন্মুক্ত, তবে সেই পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব বাংলাদেশের।
প্রভাব:
মে ২০২৫-এর এ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে ন্যূনতম স্থিতিতে নেমে আসে – কূটনৈতিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক দূরত্ব ও বাণিজ্যিক বৈরিতা সব এক সাথে কার্যকর হয়।
দুদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষ ভোগান্তি অনুভব করতে শুরু করে, চাপ বাড়তে থাকে কূটনীতি ফের চালু করার।
আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়ে;
বিশেষত চীন এই সুযোগে বাংলাদেশকে আরও সুবিধা দিতে এগিয়ে আসে (চীন বাংলাদেশকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত আরও কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বাড়ানোর ঘোষণা করে)।
পশ্চিমা দেশগুলো ও বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো বাংলাদেশ-ভারতের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে পর্দার আড়ালে আলোচনা শুরু করে যেন সরবরাহ শৃঙ্খল ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
তবে মোটের উপর,
মে ২০২৫-এর মাঝামাঝি পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে উভয় দেশই বুঝতে পারে সংঘাতে কারও লাভ হচ্ছে না – ফলশ্রুতিতে দু’পক্ষই পরবর্তীতে কিছুটা নমনীয় অবস্থানে আসার ইঙ্গিত দিতে শুরু করে।
২৮ মে ২০২৫ – নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
মে ২০২৫ শেষে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রশ্নটি গুরুতর হয়ে ওঠে।
২৮ মে ঢাকা সফরে আসা জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ লীগের সভাপতি তারো আসোর সাথে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস ঘোষণা করেন যে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে।
ইউনুস জানান, তারা “মুক্ত, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য” নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে সংস্কার চালাচ্ছেন।
এই ঘোষণার মাধ্যমে ইউনুস সরকার ছয় মাসের একটি সময়ফ্রেম দেয়
(২০২৫ সালের ডিসেম্বরে কিংবা ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন না হয়ে তা পরবর্তীতে গড়ানোর ইঙ্গিত) যাতে রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সময় নেয়া যায়।
অন্যদিকে,
ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জোরালোভাবে চাইছিল নির্বাচন যেন অবিলম্বে ও সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের দ্রুত “অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ” নির্বাচন আয়োজনে আহ্বান জানায় এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নষ্ট হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘও বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং তারা প্রচ্ছন্ন চাপ দেয় যেন বিরোধীদের সাথে সমঝোতা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্লেষণ:
তারো আসো'র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অতিথির কাছে ইউনুসের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা ঘোষণা কৌশলগত।
একদিকে এটি জাপানসহ উন্নয়ন অংশীদারদের আশ্বস্ত করে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার মোহে অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে চায় না – তারা নির্বাচন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর বাড়তে থাকা বৈদেশিক চাপ হালকা করাও এর উদ্দেশ্য।
তবে ইউনুস নির্বাচনের সময় নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতাও রাখেন, কারণ ছয় মাসের “উইন্ডো” (দিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ পর্যন্ত) উল্লেখ করে পরোক্ষভাবে সংকটাপন্ন নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ভোট পিছিয়ে ২০২৬ সালেও নিতে চান।
ভারত ও পাশ্চাত্য এই দীর্ঘসূত্রতায় স্বস্তি পায়নি, বরং তারা চায় ২০২৫ সালের মধ্যেই ভোট হোক।
বিশেষ করে ভারত প্রকাশ্যে বলেছে
তারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে দেখতে চায় এবং নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে সকলের জন্য আইনসম্মত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক।
প্রভাব:
ইউনুসের ঘোষণায় বাংলাদেশের রাজনীতি কিছুটা গতি পায় –
বিএনপি, জাতীয় পার্টি সহ অন্য দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা শুরু করে এবং ইউনুস সরকারও একটি “নরম ভূমিকা” নিতে শুরু করে যেন সবাই অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়।
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি দেশ ঘন ঘন বিবৃতি ও বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি ও সহায়তার আশ্বাস দিতে থাকে।
দ্বিপাক্ষিক দিক থেকে,
ভারত স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে তারা নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা এই নির্বাচনের মানের উপর নির্ভর করবে বলে মনে করে – ফলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও সম্পর্ক সচল রাখার স্বার্থে আন্তর্জাতিক চাহিদা কিছুটা মেনে নির্বাচনী পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করে।
মে ২০২৫ শেষে এসে বোঝা যায় যে সব উত্তেজনা, বিরোধ ও নিষেধাজ্ঞার পরও দুই দেশই চায় একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ, যেখানে বৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হবে – কারণ সেটিই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক গতি আনতে পারে।
সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ সময়কালে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একের পর এক সংঘাত, দর-কষাকষি ও সাময়িক সমঝোতার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।
শেখ হাসিনার পতন ও নতুন সরকারের অভ্যুদয়ের ফলে শুরুতে চরম কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, যা দু’দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলে।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ে, পররাষ্ট্র নীতিতে বাংলাদেশ নতুন মেরুকরণে (চীনের দিকে) ঝোঁকে এবং ভারত তার প্রতিক্রিয়ায় কৌশল পরিবর্তন করে।
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নজিরবিহীন প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ দেখা যায় – নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় যুগের পর যুগের সহজ বাণিজ্যপ্রবাহ ব্যাহত হয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন বাস্তবতা তৈরি হয় – শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে চলে যাওয়া ভারতসহ প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে নতুন সমীকরণের সামনে দাঁড় করায়।
তবে এই উথাল-পাথালের মধ্যেও দু’দেশ পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করেনি; সীমান্ত নিরাপত্তা, জনগণের যাতায়াত, অবশিষ্ট বাণিজ্য ও আঞ্চলিক ফোরামে সহযোগিতা খানিকটা হলেও চলমান ছিল।
মে ২০২৫ নাগাদ চাপা উত্তেজনা সত্ত্বেও উভয় পক্ষই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা তাদের নিজেদের স্বার্থেই জরুরি।
সামনে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নতুন সরকারের জন্মই নির্ধারণ করবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কোন পথে যাবে – সাময়িক তিক্ততা কাটিয়ে পুরনো বন্ধুত্বের পথে ফিরে আসবে, নাকি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায় শুরু হবে।
এই নয় মাসের ঘটনা প্রবাহ থেকে সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল ও বহুস্তরপূর্ণ; অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও জনমানুস – প্রতিটি উপাদান এই সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
ভবিষ্যতে দুই দেশ যদি পরস্পরের সার্বভৌম মর্যাদা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারে (যেমনটি অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে আহ্বান জানানো হয়েছিল), তবে আস্থা পুনর্স্থাপিত হতে পারে।
অন্যথায়, অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বজায় থাকলে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা হ্রাস পেয়ে অঞ্চলটির নিরাপত্তা ও উন্নয়ন দুটোই বিঘ্নিত হবে। সমস্ত ঘটনাবলীর পরিসীমা বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে আলোচনা ও কূটনৈতিক মীমাংসাই হচ্ছে এই টালমাটাল অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ, যা বাংলাদেশ ও ভারতের নেতৃবৃন্দকেই দৃঢ় সদিচ্ছায় অনুসরণ করতে হবে।
আমার মন্তব্যঃ
আমি কোনো বড় বিশ্লেষক না, সাংবাদিক তো না-ই। তবে চোখ মেলে তাকালে যা দেখি, সেটা নিয়ে ভাবি।
মাঝেমধ্যে মনে হয়,
আমি যেভাবে জিনিসগুলো দেখি, সেটা হয়তো অনেকের থেকে একটু আলাদা। কিন্তু একটাই কথা—চেষ্টা করি, যা সত্যি তা বুঝতে।
তবে একটা জিনিস বুঝেছি—অনেক সময় আমরা ‘পর্যালোচনা’ করতে গিয়ে আসল তথ্যটাই হারিয়ে ফেলি। একটা ঘটনার মানে করতে গিয়ে, আমরা নিজস্ব ব্যাখ্যা জুড়ে দিই, আর ধীরে ধীরে আসল ঘটনা আড়ালে চলে যায়। এই জায়গাটা ভয়ংকর। কারণ, এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়।
আমি তাই এখন থেকে চেষ্টা করবো, ফ্যাক্ট মানে আসল ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে—সেটা আলাদা করে তুলে ধরতে। তারপর বলবো, আমার মতে এর মানে কী হতে পারে, বা এর পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
কারণ, তথ্য আর ব্যাখ্যার মাঝখানে যদি ভারসাম্য না থাকে, তাহলে দেশ নিয়ে ভাবনার জায়গাটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আর আমি চাই—সত্য জেনেই দেশটাকে ভালোবাসি।
এই লেখা ছিলো শুধুমাত্র ভারত-বাংলাদেশ এর কূটনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। পরের পর্বে থাকবে 'আড়ালে তখন কি চলছে সেসব নিয়ে'। আসল পর্বে এসব ঘটনা টেনে নিয়ে গেলে হ-য-ব-র-ল হয়ে পড়বে তাই এক পর্বেই সব তুলে ধরলাম।
রসুনের বেশির ভাগ কোয়া এখানে আছে। বাকি কয়েকটা কোয়া মিলে গেলেই যা দেখা যাবে কাকতালীয় ভাবে সেটা হতে পারে দাদাদের কোয়া সহ মিলেমিশে এনসিপি বা বিএনপি'র......(বাকিটা বললাম না)।
তথ্যসূত্র:
- https://www.dhakatribune.com/bangladesh/foreign-affairs/357738/yunus-dhaka-delhi-relations-should-be-based-on
- https://netra.news/2025/anti-india-sentiments-simmer-across-bangladesh/
- https://www.newindianexpress.com/world/2024/Nov/30/students-in-bangladesh-urged-to-desecrate-indian-tricolour-iskcon-emblem
- https://en.wikipedia.org/wiki/2024_attack_on_the_Bangladesh_Assistant_High_Commission_in_India
- https://www.rediff.com/news/report/india-regrets-breach-of-bangladesh-mission-in-tripura/20241202.htm
- https://www.mea.gov.in/press-releases.htm?dtl/38733/Foreign_Secretarys_Visit_to_Bangladesh=
- https://www.dhakatribune.com/bangladesh/foreign-affairs/368999/pranay-verma-india-bangladesh-have-so-many-things
- https://www.indiatoday.in/india/story/bangladesh-india-ties-foreign-secretary-vikram-misri-muhammad-yunus-2647357-2024-12-09
- https://apnews.com/article/6effef70de22f18c502a7791360ece08
- https://www.theguardian.com/world/article/2024/sep/03/a-myopic-policy-indias-backing-of-ousted-bangladesh-leader-sheikh-hasina-leaves-it-in-a-bind
- https://www.ft.com/content/529af3e0-0cf1-4d19-915c-b887108c4e03
- https://www.aljazeera.com/features/2024/12/12/our-lives-dont-matter-in-post-hasina-bangladesh-hindus-fear-future
- https://www.tbsnews.net/bangladesh/fugitive-party-trying-unsettle-country-prof-yunus-tells-bbc-bangla-1083031
- https://timesofindia.indiatimes.com/india/indian-foreign-secretary-likely-to-visit-bangladesh-next-week/articleshow/115978012.cms
- https://www.scmp.com/week-asia/politics/article/3304625/what-yunus-china-trip-means-bangladeshs-india-ties-deep-optics
- https://www.reuters.com/world/asia-pacific/indian-pm-modi-bangladeshs-yunus-hold-first-talks-after-hasina-exit-2025-04-04/
- https://openthemagazine.com/feature/muhammad-yunus-and-the-destruction-of-india-bangladesh-ties/
- https://www.ft.com/content/529af3e0-0cf1-4d19-915c-b887108c4e03
- https://timesofindia.indiatimes.com/india/india-backs-early-elections-in-bangladesh/articleshow/121500201.cms