ভূ-রাজনীতির ছায়াযুদ্ধঃ জঙ্গি জঙ্গি খেলা - দেশ ছাড়িয়ে আরাকানে!

ভূ-রাজনীতির ছায়াযুদ্ধঃ জঙ্গি জঙ্গি খেলা - দেশ ছাড়িয়ে আরাকানে!
প্রথম পর্ব পড়ে আসুন আগেঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, পুনর্বাসন, আর এক রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (9/11) ধ্বংসযজ্ঞ বদলে দেয় গোটা পৃথিবীর কূটনৈতিক মানচিত্র। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করে, আর সেই ছায়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ খোঁজে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে NSSP (Next Steps in Strategic Partnership) চুক্তির মাধ্যমে ভারত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের প্রধান কৌশলগত শক্তি।

এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় জঙ্গি সংকটের ঢেউ। ২০০২ থেকে ২০০৫—এই সময়টায় একের পর এক সিরিজ বোমা ও গ্রেনেড হামলা কাঁপিয়ে তোলে দেশ: সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, বগুড়া, নাটোর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম—প্রায় ১৩টি জেলায় বিস্ফোরণে নিহত হন শত শত মানুষ। এক যোগে ৬৩ জেলায় চালানো হয় বোমা হামলা!

২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার এবং একই বছরের ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা—এই দুই ঘটনা যেন পুরো ষড়যন্ত্রের ছায়া স্পষ্ট করে। দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ফিরে পায় আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও পশ্চিমা সমর্থন

এই সময়টায় আওয়ামী লীগ নিজেকে "সেকুলার শক্তি" হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের খ্রিস্টান নারী ক্রিস্টিন ওভারমায়ারকে বিয়ে, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের ব্রিটিশ খ্রিস্টান স্বামী—এই সম্পর্কগুলো পশ্চিমা বিশ্বে একটি "সহনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ইমেজ" গড়ে তোলে। ভারতও এ কৌশলের পূর্ণ সমর্থনে পাশে দাঁড়ায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং জঙ্গিবাদ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। একে একে ধ্বংস করা হয় HUJI, JMB, এবং নতুন গঠিত নিউ জেএমবি।

কিন্তু ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে ঘিরে আবার মাথাচাড়া দেয় 'তথাকথিত' মৌলবাদী শক্তি—জামায়াত-হেফাজত-চরমপন্থীরা। ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় 'মুক্তচিন্তার উপর ধারাবাহিক আক্রমণ'

২০১৫-১৬ পর্যন্ত একে একে খুন হন অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর, অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রীসহ আরও অনেকে।

সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই, ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ নিহত হন ২২ জন। দায় স্বীকার করে Islamic State (IS)

এখানেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে "জঙ্গি খেলা" আপাতত শেষ হয়। ভারত-সমর্থিত সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূল করে নিরাপত্তা জোরদার করে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের 'ব্রেক'—তিন মাসের বিরতি!

খেলা সরানো হয় অন্য কোথাও—মিয়ানমারের রাখাইনে! জন্ম হয় আরসা (ARSA) নামের এক জঙ্গি সংগঠন। যার পিছনে আছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে জন্ম নেয়া আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী। যাকে সাপোর্ট দিচ্ছে মিডল ইস্টের আল কায়েদা, আফগানিস্তানের তালেবান ও পাকিস্তানের আইএসআই! (দাবী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এর)

যারা প্রথম মায়ানমার পুলিশের চৌকিতে হামলা করেন অক্টোবর ২০১৬ তে!

রোহিঙ্গা গণনিধনের পেছনের গল্প: আগুন, রক্ত আর নিরব ষড়যন্ত্র

সেই রাতটা ছিল অদ্ভুত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট—রাখাইনের আকাশে ছিল অন্ধকার, কিন্তু মাটিতে জ্বলছিল আগুন। হঠাৎ করেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) নামের এক রহস্যময় দল, মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালালো।

ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশন রাখাইন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। কিন্তু শান্তির কাগজ তখন আগুনে পুড়ছিল। (মায়ানমারের সেনাবাহিনী ততদিনে বহিরাগত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের নামে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিধন শুরু করে দিয়েছে)।

এই হামলার অজুহাতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুরু করলো ইতিহাসের এক নির্মমতম প্রতিশোধ—ক্লিয়ারেন্স অপারেশন! কিন্তু আসলে কি এটি প্রতিশোধ ছিল, নাকি বহু বছর ধরে প্রস্তুত করা এক "জাতিগত শুদ্ধি অভিযান"? সেই রাতে যেনো পুরো রাখাইন এক শয়তানি থিয়েটারে পরিণত হলো। শিশুদের আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হলো, নারীদের গাছে বেঁধে গণধর্ষণ করা হলো, আর গ্রাম পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হলো—যেনো কারো মনে দয়া জেগে না ওঠে, এমন নির্মমতায়।

রোহিঙ্গাদের ইতিহাসে নিপীড়ন নতুন কিছু নয়। ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এরপর তাদের পরিচয় শুধু একটাই—"অবৈধ অনুপ্রবেশকারী"। তাদের স্কুলে যেতে দেয়া হয়নি, হাসপাতালে চিকিৎসা মিলেনি, এমনকি বিয়ে করতে গেলেও অনুমতির দরকার হতো। ধীরে ধীরে তাদের অস্তিত্বই যেনো নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল মাটির দেশে। কিন্তু ২০১৭ সাল—এটা ছিল ভিন্ন কিছু। এটি ছিল তাদের সম্পূর্ণ মুছে ফেলার পরিকল্পনা

মাত্র কয়েক সপ্তাহেই সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এলো বাংলাদেশের দিকে। বাচ্চারা কারো কোলে, মায়েরা চোখে অশ্রু আর বুকের দুধ শুকিয়ে ফেলে, পেছনে পুড়ে যাওয়া ঘর, পায়ের নিচে কাঁদা, সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। তারা জানত না, তারা কোন দেশে যাচ্ছে, কে তাদের বাঁচাবে, বা আদৌ কেউ তাদের বিশ্বাস করবে কিনা।

কক্সবাজারের ছোট্ট উপকূল তখন যেনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির আখড়া হয়ে উঠলো। বনভূমি কেটে বানানো হলো টিনের ছাউনি, মাটিতে পাতানো হলো পলিথিন, আর আকাশে ছড়িয়ে পড়লো শুধুই কান্নার ধ্বনি। কুতুপালং শরণার্থী শিবির আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিবির—কিন্তু এর গল্পটা শুধু সংখ্যা না, এটা একেকটি পরিবারের সর্বনাশের ইতিহাস।

আরেকদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখে প্রতিবাদ জানালেও, কাজের বেলায় সবাই চুপ। চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করলো। আবার কিছু রাষ্ট্র বললো, “হ্যাঁ, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, কিন্তু এটা আমাদের ‘জিও-পলিটিক্স’-এর অংশ না।” মানবতা তখন কাঁদছিল, কিন্তু কূটনীতি হাসছিল।

এদিকে গোপনে গোপনে মামলা গড়াতে থাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। গাম্বিয়া এগিয়ে আসে, আর ২০২৪ সালে মামলার তদন্তকারীরা খুঁজে পায় এমন সব তথ্য—যা মনে হলে ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিশুদের ওপর আগুন ঢেলে দেওয়া, মা-বোনের ধর্ষণ ভিডিও করে সেনারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে গর্ব করে, আর গণকবর ঢেকে ফেলা হয় সরকারি বুলডোজারে। এটি কোনো হঠাৎ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না—এটি ছিল এক নিখুঁত ‘ethnic cleansing’।

এই ঘটনার ফলে শুধু মানুষ নয়, হারিয়ে গেছে একটি জাতির আশা, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ। আজ, লাখ লাখ রোহিঙ্গারা কাঁদছে সেই প্রশ্নে—

"আমরা কি মানুষ না?"

এই গল্প শুধু রোহিঙ্গাদের নয়। এটি আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের নীরবতার দলিল। আর যদি আপনি মনে করেন এই ট্র্যাজেডি শেষ, তাহলে ভুল করছেন—কারণ ইতিহাসের এই অধ্যায় এখনও চলছে, শুধু এবার পাতা উল্টে গেছে অন্য দিকে।

একটি প্রশ্ন—আর তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শত রহস্য...

কেনো রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি, তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হলো?

শুধু ধর্মীয় পরিচয় ‘মুসলমান’ হওয়ার কারণে?

নাকি এর আড়ালে ছিল আরেকটি গভীর, সুপরিকল্পিত, বহুস্তরবিশিষ্ট ষড়যন্ত্র?

যদি প্রশ্নটা এতই সরল হতো, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে সহানুভূতিশীল মানবিক সংগঠনগুলো—জাতিসংঘ, আইসিসি, এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার মানবাধিকার রক্ষাকারীরা—এতো দিনেও কেনো এর বিচার করে উঠতে পারলো না?

রোহিঙ্গারা শুধু রাখাইনের জনপদে বসবাসকারী এক মুসলিম সংখ্যালঘু?

না কি রাখাইন উপকূলে থাকা চীন-ভারত সাপ্লাই চেইনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধক?

তারা ছিল সেই মাটি ও করিডোরের কাঁটা, যার ওপর দিয়ে চীন গড়ে তুলতে চাইছিল তার CMEC করিডোর, আর ভারত চাইছিল কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট?

আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়—

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কখনো কারেন বা কাচিন খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এত ভয়াবহ গণহত্যা করেনি, যদিও তারাও বিদ্রোহী। তাহলে রোহিঙ্গারা কেন?

শুধুই ধর্মের কারণে?

নাকি…

রোহিঙ্গাদের বিদায় নিশ্চিত করেই রাখাইনকে বানানো হবে এক বৌদ্ধ-মেজরিটি ‘আরাকান ন্যাশন’-এর ভবিষ্যৎ রাজধানী, যেখানে থাকবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ, চীনা বিনিয়োগ, ভারতীয় করিডোর, আর জাপানি চুপচাপ অংশীদারিত্ব?

আরেকটা রহস্য জেগে ওঠে—

ARSA কি সত্যিই রোহিঙ্গাদের রক্ষাকারী ছিল, না কি তারা ছিল এক সুপরিকল্পিত ফাঁদ?

২৫ আগস্টের সেই হামলা, ঠিক কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরেই কেনো হলো?

এই ‘হামলা’ কি মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজেই সাজিয়েছিল, যেনো তারা "সন্ত্রাস দমন" এর নামে পুরো জাতিকে মুছে ফেলতে পারে?

সব প্রশ্নের উত্তর এখনো অন্ধকারে।

তবে ইতিহাস আমাদের এতটুকু শিখিয়েছে—

যেখানে তেল, করিডোর আর ধর্ম একসাথে মিশে যায়, সেখানেই জন্ম নেয় সবচেয়ে রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র!

কিন্তু আমরা এখানেই থামবো না...

প্রতিটি ঘটনার পাতা উল্টাবো, প্রতিটি লাইন পড়বো আবার,

ডট খুঁজে বের করবো, তারপর সেই ডটগুলোকে কানেক্ট করে দেখতে চাই।

বুঝতে চাই আসলে কেনো রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে

কে ছিল এর পিছনের রচয়িতা?

কাদের স্বার্থে এক জাতিকে পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হলো?

এই গল্প শুধু মানবিক সংকট নয়—

এটি একটি নিখুঁতভাবে সাজানো ভূ-রাজনৈতিক অপরাধের গল্প

একটি জাতির কান্না, আর অন্য কারও বিজয়মিছিল।

এবার আমরা সেই গল্পের গভীরে নামবো।

এক এক করে পর্দা সরাবো!

ভারতের গোপন দ্বার, যা সেভেন সিস্টারকে মুক্তি দেবে

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল—মিজোরাম, মণিপুর, আসাম, নাগাল্যান্ড… এসব রাজ্যকে ঘিরে রয়েছে অবিশ্বাস, বিচ্ছিন্নতা, এবং এক কৌশলগত দুর্বলতা। এই “সেভেন সিস্টারস” ভারতের শরীরের অংশ হলেও, মনে হয় যেন আলাদা একটি দ্বীপ।

ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এসব রাজ্যে পৌঁছাতে হলে ভরসা করতে হয় একমাত্র সরু ‘সিলিগুড়ি করিডোর’-এ, যাকে অনেকে বলে “চিকেনস নেক”—যেকোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটি ভারতের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যারেল।

২০০৮ সালে ভারত একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়—বাংলাদেশ বা চীনের ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব করিডোর তৈরি করবে, যা সরাসরি বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করবে।

এই সিদ্ধান্তই জন্ম দেয় —Kaladan Multi-Modal Transit Transport Project (KMTTP) তথা 'কালাদান প্রকল্প'

কালাদান প্রকল্প কীভাবে কাজ করে?

১. সমুদ্রপথ – কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে মাল যাবে মিয়ানমারের সিত্তওয়ে সমুদ্রবন্দর
২. নদীপথ – সেখান থেকে কালাদান নদী ধরে যাবে মিয়ানমারের পালেতওয়া পর্যন্ত
3. সড়কপথ – পালেতওয়া থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের জোরিনপুই পর্যন্ত ১০৯ কিমি সড়ক

এই তিন ধাপ মিলেই তৈরি হয় এক বিকল্প আন্তর্জাতিক রুট, যা ভারতের জন্য শুধু বাণিজ্য নয়, বরং নিরাপত্তার দিক থেকে একটি লাইফলাইন

ভারতের কৌশলগত মানচিত্রে কালাদানের স্থান

  • বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা কমানো: এই প্রকল্প ভারতকে স্বাধীনভাবে উত্তর-পূর্বে পৌঁছার সুযোগ দেবে।
  • চীনের ঘিরে ফেলার কৌশল ভাঙা: চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে CMEC করিডোর বানাচ্ছে। কালাদান হলো ভারতের পাল্টা চাল।
  • সেনা মোতায়েনের বিকল্প রুট: এটি কেবল বাণিজ্যিক করিডোর নয়, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদের চলাচলের পথ হিসেবেও কাজ করবে।
  • উত্তর-পূর্বে জাতিগত উত্তেজনা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন: উন্নয়ন ও সংযুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হবে।

ভারতের প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক মহলে কালাদান প্রকল্পকে বলা হয়—

"The artery that connects the neglected limb to the heart."

তবে এই স্বপ্নপথ এত সহজ ছিল না…

এই প্রকল্পের সবচেয়ে দুর্বল অংশটি হলো—এর প্রায় ৬০% পথ মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চল, রাখাইন ও চিন রাজ্যের ভেতর দিয়ে যায়—যেখানে পাহাড়ি, দুর্গম অঞ্চল, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া নদী এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম।

একটা সময় ভারতের কর্মকর্তারাও বুঝে যান—
এই করিডোর শুধু রাস্তা বা নদীর প্রশ্ন না, বরং এটি এক 'হট জোন' দিয়ে যাওয়ার সাহসী যাত্রা।

সেই সাহস থেকেই ভারত নিজে হাতে তদারকি শুরু করে-

কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প

ভারতের চোখে এটি ছিল একটি নিরব বিপ্লব—একটি বিকল্প করিডোর, যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে কলকাতা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে। ভারত চাইছিল না আর বাংলাদেশের করিডোরে নির্ভরশীল থাকতে, চাইছিল না চীনের ছায়ায় বন্দী থাকতে। তাই কলকাতা থেকে সিত্তওয়ে, সেখান থেকে পালেতওয়া, আর শেষে মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত গড়ে তুলতে চায় এক মাল্টিমোডাল করিডোর, যা সমুদ্র, নদী আর সড়কের যুগলবন্দি।

তবে এই করিডোরের যাত্রাপথ কেবল মানচিত্রের রেখা ছিল না—এটি ছিল রাখাইনের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া এক অগ্নিপথ।

চীনের CMEC!

ঠিক তখনই, চীন তার CMEC নামের এক বিশাল অর্থনৈতিক করিডোর শুরু করে।

চীনের China–Myanmar Economic Corridor (CMEC) প্রকল্পের অংশ হিসেবে কিয়াউকপিউ (Kyaukphyu) থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন এবং রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এই পাইপলাইনটি রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে গেছে, যেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসতি ছিল।

বিশেষ করে মংডু (Maungdaw) এবং বুথিডং (Buthidaung) অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ঘন বসতি ছিল, যা পাইপলাইনের রুটের কাছাকাছি।

তবে পাইপলাইনটি সরাসরি রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে গেছে কিনা, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

আর এই দুই প্রকল্প—ভারতের কালাদান, চীনের CMEC এবং বহু শতাব্দী ধরে বাস করে আসছিল এক ভিন্নধর্মী জাতি রোহিঙ্গা মুসলমান!

সবগুলো এসে একটি বিন্দুতে যুক্ত হয়ে যায়: রাখাইন রাজ্যে!

এক রাজ্য, বহু সংঘর্ষ

রাখাইন রাজ্যের উপকূল ও উত্তরাঞ্চল জুড়ে ছিল রোহিঙ্গাদের ঘন বসতি, বিশেষ করে মংডু ও বুথিডং এলাকায়।

এদের অস্তিত্ব ছিল এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা—চীনের পাইপলাইনের রুটের পাশেই তারা বাস করতো,

আর ভারতের কালাদান প্রকল্পের কাছাকাছিও ছিল তাদের ছড়িয়ে থাকা জনপদ।

কিন্তু এসব উন্নয়ন প্রকল্পের নকশায় রোহিঙ্গা বলে কিছু ছিল না।

আর এখানেই শুরু হয় নিষ্ঠুর, সুপরিকল্পিত এক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া—

যার কেন্দ্রে ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী (Tatmadaw) এবং রাখাইনের বৌদ্ধ চরমপন্থী গোষ্ঠী।

সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের গোপন আঁতাত

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কখনই রোহিঙ্গাদের “নাগরিক” হিসেবে মেনে নেয়নি।

১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলমান রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপ নেয়।

২০১২ সাল থেকে, রাখাইনে বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দ্বারা মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া, বাজার জ্বালানো, গণধর্ষণ ও লুটপাট শুরু হয়।

সেনাবাহিনী তখন মুখ ফিরিয়ে রাখে, কখনো কখনো সহায়তাও করে।

কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।

এক রাতের মধ্যে ৩০টিরও বেশি সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী ARSA হামলা চালানোর পর,

মিয়ানমার সেনাবাহিনী “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” নামে শুরু করে এক নির্মম গণহত্যা।

হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গর্ভবতী নারী ও শিশুর ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। গণকবর ভরিয়ে তোলা হয় নিথর দেহে!

তাহলে প্রশ্ন জাগে—এটা কি শুধুই প্রতিশোধ ছিল?

নাকি এটি ছিল এক কৌশলগত ‘Ethnic Clearance’,

যার মাধ্যমে উন্নয়নের পথে থাকা এক জাতিগোষ্ঠীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল?

রাখাইন রাজ্যকে “পরিষ্কার” করে সেখানে সড়ক, বন্দর, পাইপলাইন বানানোর পথ তৈরি হয়

তাহলে রোহিঙ্গারা কি এই দুই প্রকল্পে কোনো ধরনের বাধা দিয়ে ভারত-চীন ও মায়ানমার সরকার, সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধদের রোষানলে পড়ে?

বিতাড়িত হয় নিজ ভূমি থেকে?

আসুন, প্রশ্ন যেহেতু উঠেছে, উত্তর খুঁজি—প্রমাণের আলোয়, সংযোগের ছায়ায়।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
তাদের গ্রাম, মসজিদ, বাজার—সব ছিল মূলত মংডু, বুথিডং ও রথেদং এলাকায়।

অন্যদিকে ভারতের কালাদান প্রকল্পের মূল নৌরুট ও সড়কপথ এবং চীনের CMEC করিডোরের পাইপলাইন ও রেলপথ—এই দুটি যাতায়াত রেখা গড়ে উঠেছে রাখাইনের মধ্য ও দক্ষিণ অংশ ঘিরে, যেমন সিত্তওয়ে ও কিয়াউকপিউ অঞ্চল।

এখন যদি খুঁটিয়ে দেখি—
রোহিঙ্গারা প্রকল্পের রুটে ছিল না। তারা প্রকল্পে কর্মরত ছিল না।
তাদের হাতে ছিল না অস্ত্র, ছিল না সংগঠিত কোনো সশস্ত্র প্রতিরোধ।
তারা রাষ্ট্রবিহীন, অধিকারবঞ্চিত, নাগরিকত্বহীন,
এমনকি নিজেরাই দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়ানো শরণার্থী হয়ে পড়েছিল।

তাহলে কি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রোহিঙ্গারা কখনো এই প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে?
কোনো চেকপোস্টে হামলা? কোনো নির্মাণ কাজে বাধা? কোনো আন্তর্জাতিক বিবৃতি?
কিছুই নেই।

কোনো কিছু না করেও কেন তাহলে রোহিঙ্গাদের কে বিতাড়িত করা হলো নিজ ভূমি থেকে?

আসুন ফিরে যাই সেইখানে, যেখান থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে-

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে, যে রাতে ARSA মিয়ানমারের প্রায় ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায়। আর সাথে সাথেই মায়ানমার সেনাবাহিনী 'সন্ত্রাসবাদ' আখ্যা দিয়ে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এর মাধ্যমে পুরো জাতিকে টার্গেট করে।

তাহলে কি ARSA দায়ী?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—ARSA কি ভারতের কালাদান প্রকল্পে হামলা চালিয়েছিল?
বা চীনের পাইপলাইন, সড়ক, রেললাইন বা কিয়াউকপিউ বন্দরে?

একটিও নয়।

ARSA-এর কার্যক্রম ছিল সীমিত, স্থানিক, প্রতীকী, এবং মূলত মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনা বাহিনীকে ঘিরেই

কোনো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক করিডোর, পরিকাঠামো, প্রকল্পে তাদের কোনো আক্রমণ, বাধা বা হুমকির প্রমাণ নেই।

তাদের কোনো রাজনৈতিক ইশতেহারে, লক্ষ্যবস্তু তালিকায় ভারতের বা চীনের প্রকল্প নেই।
তাদের মূল দাবি ছিল রোহিঙ্গা জনগণের সুরক্ষা এবং পুনঃনাগরিকত্ব। যদিও আরসা কে রোহিঙ্গা রা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কখনো স্বীকারও করেনি। বরং, রোহিঙ্গারা মনে করে আরসা'র কারণেই তাদের কে ভূমিহারা হতে হয়েছে!

তাহলে প্রশ্নটা আবার ফিরে আসে, আরও শক্তভাবে—

রোহিঙ্গারা প্রকল্পে বাধা দেয়নি, ARSA-ও সরাসরি কোনো করিডোরের বিরুদ্ধে ছিল না—
তাহলে একটি গোটা জনগোষ্ঠীকে এমন ভয়াবহভাবে উচ্ছেদ করা হলো কেন?
কার স্বার্থে? কিসের পরিবর্তে?

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য চালু হওয়া কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রকল্প ছিল নয়াদিল্লির জন্য একটি কৌশলগত স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্নের করিডোরকে কেন্দ্র করে যে অদৃশ্য সংঘর্ষ জমে উঠছিল, তার নায়ক হয়ে ওঠে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী—আরাকান আর্মি (AA)

আরাকান আর্মির উত্থান ভারতের জন্যে বিষফোঁড়া!

২০০৯ সালে কাচিন রাজ্যে গোপনে জন্ম নেওয়া এই গোষ্ঠী প্রথম কয়েক বছর কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির সহায়তায় প্রশিক্ষণ ও সংগঠনের কাজে নিয়োজিত ছিল।

কিন্তু ২০১৪ সালের শেষের দিকে তারা রাখাইনের দক্ষিণ ও চিন রাজ্যের উত্তরাংশে, বিশেষত পালেতওয়া ও কিয়াউক্তাও এলাকায় প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে ঘাঁটি স্থাপন শুরু করে—যা ছিল ভারতের কালাদান করিডোরের ঠিক পাশঘেঁষা অঞ্চল

আরাকান আর্মি দাবি করে—রাখাইন হচ্ছে তাদের "জাতিগত মাতৃভূমি" এবং তারা এক স্বাধীন "আরাকান রাজ্য" প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে রাখাইন বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে, পালেতওয়া অঞ্চলে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রথম সংঘর্ষ হয়।

এই লড়াইয়ের অবস্থান ছিল কালাদান নদীপথের খুব কাছাকাছি—যেখানে ভারতের জাহাজ চলাচলের জন্য নদীর রুট নির্মাণের পরিকল্পনা চলছিল

বছরের শেষ দিকে কিয়াউক্তাও-ম্রউকউ সীমান্তে আরও সংঘর্ষ হয়, যার ফলে সেনাবাহিনী ওই অঞ্চলে বাড়তি চেকপোস্ট ও টহল বসাতে বাধ্য হয়।

এই সময় থেকেই প্রকল্প এলাকায় “নিরাপত্তা ও নজরদারি” বাড়ানো হয়, এবং পরোক্ষভাবে প্রকল্পের সময়সূচি বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে।

২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যভাগে আরাকান আর্মি রাখাইন ও পালেতওয়া অঞ্চলে প্রায় ৩,০০০-এর বেশি যোদ্ধা মোতায়েন করে

তারা স্থানীয়ভাবে “বিপ্লবী কর” আদায় শুরু করে, নির্মাণসামগ্রী ও নৌকা জব্দ করে মুক্তিপণ দাবি করে এবং প্রকল্পকেন্দ্রিক এলাকার ওপর নিজেদের “ছায়া-শাসন” চাপিয়ে দেয়।

এই সময় ভারতের তরফে উদ্বেগ বাড়ে। কালাদান নদীপথের নির্মাণ ও মাল চলাচল বারবার স্থগিত হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে

বিশেষ করে পালেতওয়ার দিকে ভারতের নির্মিত জেটি ও সড়করুটের কাজ প্রায় এক বছর স্থবির হয়ে পড়ে। ভারতকে বাধ্য হয়ে প্রকল্প-নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চাপ দিতে হয়।

২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ভারত মিয়ানমারের হাতে সিত্তওয়ে বন্দর ও পালেতওয়ার নদীবন্দর হস্তান্তর করে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরাকান আর্মির সক্রিয়তা আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে

তারা নদীপথে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন বেসরকারি ঠিকাদারদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে কাজ চালালে বাধা দেয়।

একই সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীও পালেটওয়া ও মিজোরাম সীমান্তে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয় এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অতিরিক্ত ফাঁড়ি গড়ে তোলে।

২০১৭ সালের জুলাই–আগস্টের ঠিক আগ মুহূর্তে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে একটি অলিখিত আতঙ্ক বিরাজ করছিল।

কালাদান নদীতে মালবাহী নৌকা চলাচলে রাতের বেলা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং দিনে সেনা-এসকর্ট ছাড়া নৌযান চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রকল্পের বিলম্ব

২০১৭ সালের জুনে, প্রকল্পের ১০৯ কিমি সড়ক নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, আরাকান আর্মির সক্রিয়তা এবং নিরাপত্তা হুমকির কারণে নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হয়। এই বিলম্ব প্রকল্পের সময়সূচি ও বাজেট উভয়কেই প্রভাবিত করে।

ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপাক্ষিক মহাসড়ক প্রকল্পের বিলম্ব

এই মহাসড়ক প্রকল্পটি ভারতের মোরেহ থেকে মিয়ানমারের তামু হয়ে থাইল্যান্ডের মায় সট পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করে। ২০১৭ সালে, মিয়ানমার সরকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য প্রকল্পের কিছু অংশ স্থগিত রাখে। বিশেষ করে, কালেওয়া-ইয়াগি সেকশনের ১২০ কিমি অংশের নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হয়।

মোটর ভেহিকল চুক্তির স্থগিতকরণ

ভারত ও মিয়ানমার মধ্যে একটি মোটর ভেহিকল চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা ছিল, যা উভয় দেশের মধ্যে সড়ক পরিবহন সহজতর করত। তবে, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা সংকটের আগেই এই চুক্তি স্থগিত রাখা হয়।

ইম্ফল-ম্যান্ডালে বাস পরিষেবা স্থগিতকরণ

ভারত ও মিয়ানমার ইম্ফল থেকে ম্যান্ডালে পর্যন্ত একটি বাস পরিষেবা চালুর পরিকল্পনা করেছিল। তবে, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং মোটর ভেহিকল চুক্তির অনুপস্থিতির কারণে এই পরিষেবা চালু করা সম্ভব হয়নি।

এই একই সময়ে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও “ক্লিয়ারেন্স প্যাট্রোল” নামে সেনা মোতায়েন শুরু হয়—যার ব্যাখ্যা ছিল “বিদ্রোহী অনুপ্রবেশকারীদের ধরতে অভিযান”।

এই সম্পূর্ণ পটভূমিতে, আগস্ট ২০১৭-র গণহত্যা শুরু হওয়ার ঠিক আগে রাখাইন ছিল এক বিস্ফোরণমুখো পরিস্থিতিতে।

একদিকে ভারতের প্রজেক্ট চালু রাখতে ছিল তীব্র কূটনৈতিক ও কৌশলগত চাপ, অন্যদিকে আরাকান আর্মির আগ্রাসী বিস্তার ঘটছিল ঠিক করিডোরের রুট বরাবর।

এই দ্বন্দ্ব সামাল দিতে গিয়ে সেনাবাহিনী যেভাবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলেও অভিযান শুরু করে, তা আদতে ছিল শুধু নিরাপত্তা নয়—একটি পূর্ণাঙ্গ জনবদল বা Ethnic Clearance-এর সূচনা।

মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো। কিন্তু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, চাইলেই কাউকে পুশ করতে পারে না মায়ানমার। তাই আরাকান আর্মি যখন ভারতের কালাদানে একের পর বাঁধা দিতে থাকে, ঠিক এই সময়ে নিরাপত্তা ইস্যু দেখিয়ে ভারতের সাথে সব চুক্তি স্থগিত করে বসে মায়ানমার সরকার।

রোহিঙ্গারা পড়ে যায় ভারত-মায়ানমারের দর কষাকষির মাঝখানে!
মায়ানমারের প্রস্তাবে ভারত রাজী হবে খুবই স্বাভাবিক। আর ভারতের করদ রাজ্য বাংলাদেশ। যা বলবে তাই করবে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশ করতে গেলে যে আন্তর্জাতিক চাপ পড়বে সেটা সামলানোর দায়িত্ব দেয়া হয় চীন কে। চীন সেটা করবে কারণ রাখাইনের উপর দিয়ে তার প্রকল্প আছে আর মায়ানমারকে সে ব্যাকআপ দিয়ে আসছে বহু বছর ধরে।

আর ভারতের নির্দেশে শেখ হাসিনার উপর দায়িত্ব থাকে, সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের কে আশ্রয় দিতে!

আর ভারত বাংলাদেশে সহায়তা পাঠাবে রোহিঙ্গাদের জন্যে এবং পশ্চিমারাও ভারতের কথা শুনবে। সাহায্য পাঠাতে ছুটে আসবে জাতিসংঘ। পশ্চিম ভারতের কথা শুনবে কারণ সময় টা ২০১৭ আর পশ্চিম বাংলাদেশে ভারতের চোখ দিয়ে দেখে!

কিন্তু একটা ইস্যু দরকার। যে ইস্যু দিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর চালাবে দমন-পীড়ন। সেটা হয়ে যায় আরসা (ARSA) র উত্থানে! নিখুঁত পরিকল্পনা!

অতঃপর দ্রশ্যপটে আসে আরসা (ARSA)

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। রাতের অন্ধকারে ARSA রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলা চালায়। আগুন, ধোঁয়া, আর চিৎকারে ভরে ওঠে মংডু ও বুথিডং।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রতিশোধের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জাতিসংঘ এই অভিযানকে “জাতিগত নির্মূল” হিসেবে অভিহিত করে।

ফলাফল?

দশ লাখ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে পালায়। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেয় এক মানবিক বিপর্যয়।

কিন্তু রহস্য আরও গাঢ় হয়। Amnesty International-এর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন বলছে, ARSA মংডু ও বুথিডংয়ে ৯৯ জন হিন্দু নারী, পুরুষ, এবং শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ARSA এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

ভারত এই ইস্যু দিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সামলায়। আরসা পাকিস্তানের ISI এর সঙ্গে, তালেবান ও আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত এই ন্যারেটিভ দিয়ে।

মন্তব্যঃ

ভারতের কালাদান প্রকল্পের উপর্যুপরি হামলার কারণে আরাকান আর্মি দেশটির প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমনের উদ্দেশ্যে ভারত একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এই পরিকল্পনায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভারত ও মিয়ানমার যৌথভাবে রাখাইনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও আরাকান আর্মির সদস্যরা প্রতিবারই মংডু ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলের পাশাপাশি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিত, যার ফলে ভারতের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অন্যদিকে, মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো। কিন্তু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, চাইলেই কাউকে পুশ করতে পারে না মায়ানমার।

তাই আরাকান আর্মি যখন ভারতের কালাদানে একের পর বাঁধা দিতে থাকে, ঠিক এই সময়ে নিরাপত্তা ইস্যু দেখিয়ে ভারতের সাথে সব চুক্তি স্থগিত করে বসে মায়ানমার সরকার।

রোহিঙ্গারা পড়ে যায় ভারত-মায়ানমারের দর কষাকষির মাঝখানে! একই সাথে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশ করতে গেলে যে আন্তর্জাতিক চাপ পড়বে তা সামলানোর দায়িত্ব দেয়া হয় চীন এবং ভারত কে। ভারতের এজেন্ট শেখ হাসিনার উপর দায়িত্ব থাকে, সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের কে আশ্রয় দিতে!

অথচ তৎকালীন রাখাইন ছিল বহুমুখী সংঘাতে জর্জরিত: আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংঘাত, সামরিক বাহিনী ও রোহিঙ্গাদের সংঘাত, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের সংঘাত এবং নবগঠিত আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)-এর সাথে আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর পৃথক পৃথক সংঘর্ষ।

এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারত কোনো একটি বিদ্রোহী পক্ষকে দমন করার কৌশল নেয় বলে মনে করা হয়। যেহেতু আরাকান আর্মি, আরসা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুগুলো পরস্পরের সাথে জড়িত ছিল, তাই অভিযোগ রয়েছে যে ভারত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে 'জাতিগত নিধন' শুরু করার জন্য প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়।

তবে, কোনো উপযুক্ত কারণ বা উস্কানি ছাড়া জাতিগত নিধনের মতো গুরুতর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না। সদ্য আত্মপ্রকাশ করা 'আরসা'-কে এই প্রেক্ষাপটে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূল ঘটনাকে আড়াল করে আরসার নামে পুরো বিষয়টি মঞ্চস্থ করা হয়েছিল, যার নেপথ্যে অন্য কোনো শক্তির কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ ওঠে।

এমনকি এও ধারণা করা হয় যে, আরসার উত্থান ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর একটি পরিকল্পিত ঘটনা হতে পারে, কেননা এ ধরনের কার্যক্রমে তাদের বিশেষ দক্ষতার কথা শোনা যায়। যা হোক, আরসার প্রাথমিক হামলাগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায়নি।

ফলে, পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় '৯৯ জন হিন্দুকে হত্যার' মতো রিপোর্ট যখন প্রকাশ হয়। যদিও এই অভিযোগের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, কারণ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনকারী হিসেবে বৌদ্ধরাই পরিচিত ছিল, হিন্দু সম্প্রদায় নয়, তাই আরসার লক্ষ্যবস্তু বৌদ্ধরাই হওয়ার কথা।

এই ঘটনাক্রমই দশ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দেয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

এসময় পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ওই সময়টিতে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। পশ্চিমা দেশগুলোও তখন বাংলাদেশকে মূলত ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যবেক্ষণ করত।

ভারত শেখ হাসিনাকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে, প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের সময় উন্মুক্ত সীমান্ত পায় এবং এদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।

আর এভাবেই তৈরি হয় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট!

আগামী পর্বে থাকবে এই অংশের ২য় পর্ব এবং সিরিজের ৩য় পর্বে জানবেন কিভাবে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভারতের কালাদান প্রজেক্টকে সুরক্ষিত করে 'বাংলাদেশ'!

এই পোস্ট সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে পারেন এই ফেসবুক পোস্টে

তথ্যসূত্রঃ

1. 9/11 এবং ভারতের NSSP চুক্তি (2004)
Source:

2. ২০০২–২০০৫: বাংলাদেশের সিরিজ বোমা হামলা
Source:

3. ২১ আগস্ট ২০০৪: গ্রেনেড হামলা
Source:

4. ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা (২০০৪)
Source:

5. HUJI, JMB ও নিউ-জেএমবি দমন (২০০৯-২০১১)
Source:

  • United Nations Security Council – Consolidated List
  • US State Department Terrorist Designations
  • The Daily Star, “JMB militant activity” archive

রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কিত রেফারেন্স

6. ARSA’র উত্থান এবং ২৫ আগস্ট ২০১৭ এর হামলা
Source:

7. ARSA কর্তৃক হিন্দু হত্যা – 99 জনের দাবি
Source:

8. জাতিগত নিধন অভিযোগ ও জাতিসংঘ প্রতিবেদন
Source:

9. International Criminal Court (ICC) case against Myanmar
Source:

10. Gambia vs Myanmar (ICJ case)
Source:

  • International Court of Justice, Application of the Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide (The Gambia v. Myanmar)
  • https://www.icj-cij.org/case/178

ভারতের কালাদান প্রকল্প ও আরাকান আর্মি সম্পর্কিত তথ্য

11. Kaladan Multi-Modal Transit Transport Project
Source:

12. Arakan Army ও তাদের তৎপরতা (2015–2017)
Source:

13. AA কর্তৃক কালাদান অঞ্চলে হামলা ও ভারতীয় উদ্বেগ
Source:

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও মতামতভিত্তিক উৎস

14. Rohingya crisis, strategic implications
Source:

  • Asia Times, Strategic costs of the Rohingya crisis, 2017
  • The Diplomat, The Rohingya Crisis and India’s Strategic Dilemma, 2017

15. China–Myanmar Economic Corridor (CMEC)
Source:

ARSA-এর উত্থানের পেছনে RAW যুক্ত থাকতে পারে এসব ক্ষেত্রে “Unverified Intelligence Assumptions” বা “Strategic Analyst Speculations” হিসাবে ধরে নিতে পারেন।

শেখ হাসিনার সরকারকে “ভারতের এজেন্ট” বলা কিংবা চীন-ভারতের যৌথ ষড়যন্ত্রে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অবশ্যই “Commentary Based on Political Interpretation” হিসেবে, যাতে পাঠক বুঝতে পারেন এটি তথ্য না, ব্যাখ্যা।