মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও সম্ভাব্য রাষ্ট্র গঠন ও বাংলাদেশের ঝুঁকি!

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে অত্যন্ত জটিল এবং বিভক্ত। দেশের ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যখন সেনা জান্তা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। নিম্নে ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক চিত্র এবং অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হলো।
সামগ্রিক ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ
- জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী: ৪২% ভূখণ্ড
- সংঘর্ষপূর্ণ এলাকা: ৩৭% ভূখণ্ড (নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিদিন সংঘর্ষ চলছে)
- সেনা জান্তা: ২১% ভূখণ্ড (নেইপিদো ইউনিয়ন টেরিটরি, ইয়াঙ্গুন মেট্রো, ম্যান্ডালে করিডর)

সেনা জান্তার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে বিমানঘাঁটি, ভারী আর্টিলারি এবং আর্থিক কেন্দ্রগুলো অবস্থিত, যা তাদের ক্ষমতার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
- জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী (৪২%): এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি (AA), চিন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি (KIA), কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (KNLA), এবং থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (3BA)। এরা মিয়ানমারের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের শক্তি বৃদ্ধির পেছনে বিদেশি সমর্থন (চীন, ভারত, পশ্চিমা এনজিও) এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
- সংঘর্ষপূর্ণ এলাকা (৩৭%): এই অঞ্চলগুলোতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সেনা জান্তার মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাগাইং ও ম্যাগওয়ে অঞ্চলে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (PDF) জান্তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই অঞ্চলগুলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন, কাচিনের জেড খনি) এবং বাণিজ্য পথ (যেমন, Myawaddy-Maesot সেতু) অবস্থিত।
- সেনা জান্তা (২১%): সেনা জান্তা কেবল কেন্দ্রীয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। এই অঞ্চলগুলোতে বিমানঘাঁটি, ভারী আর্টিলারি এবং আর্থিক কেন্দ্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াঙ্গুন মেট্রো এবং ম্যান্ডালে করিডর মিয়ানমারের অর্থনীতি ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে জান্তার এই নিয়ন্ত্রণ দিন দিন দুর্বল হচ্ছে, কারণ তারা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পিছু হটছে।
অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃত বিবরণ

রাখাইন রাজ্য (আরাকান আর্মি - AA)
- নিয়ন্ত্রিত এলাকা: রাখাইন রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সিত্তে, কিয়াউকফিউ এবং মানাউং দ্বীপ এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে এখানেও সংঘর্ষ চলছে।
- শাসন ব্যবস্থা: আরাকান আর্মি "Arakan People’s Authority" নামে একটি স্বশাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি বৌদ্ধ-রাখাইন জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক এবং স্থানীয় জনগণের সমর্থন রয়েছে।
- প্রশাসনিক কাঠামো: তারা সীমান্তে নতুন ট্যাক্স পোস্ট স্থাপন করেছে, স্থানীয় আদালত ও পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে। এই ব্যবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় স্থিতিশীলতা এনেছে এবং জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা ইস্যুতে জটিল অবস্থানে রয়েছে। তারা ‘নিরাপদ এলাকা’ নিশ্চিত করার শর্ত দিয়েছে, কিন্তু জাতীয় ঐক্য সরকার (NUG) এবং পশ্চিমা মহল এতে সন্তুষ্ট নয়। ২০২০-২১ সালে আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ARSA-এর মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে, যা এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
- ভারতের সাথে সম্পর্ক: ভারতের Kaladan Multi-modal Transit Transport Project রাখাইনের সিত্তওয়ে বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৯ সালের ‘অপারেশন Sunrise’ এর পর ভারত এবং আরাকান আর্মির মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যার ফলে এই প্রকল্পে আরাকান আর্মি বাধা সৃষ্টি করছে না।
রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি কারণ তাদের সরাসরি সমুদ্রপথ আছে, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান আর্মি তাদের শাসন ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সমর্থনের মাধ্যমে একটি কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলেছে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত ও চীনের সমর্থন তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে।
চিন রাজ্য (চিন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স)
- নিয়ন্ত্রিত এলাকা: চিন রাজ্যের মিনদাত-মাতুপ-কানপেটলেট বেল্ট এখন চিন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের নিয়ন্ত্রণে। এটি রাখাইনের ঠিক উত্তরে অবস্থিত (তৃতীয় চিত্রে দেখানো)।
- শাসন ব্যবস্থা: তারা "Chinland Interim Council" নামে একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসন কাউন্সিল গঠন করেছে। এটি খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
- প্রশাসনিক কাঠামো: চিন ব্রাদারহুড নিজস্ব ফেডারেল সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছে। তারা গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বোর্ড গঠন করেছে, যা তাদের শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে।
- অর্থনৈতিক সমর্থন: খ্রিস্টান চার্চ নেটওয়ার্ক তাদের প্রধান অর্থ ও সরবরাহের উৎস। পশ্চিমা এনজিওগুলো এই অঞ্চলে "Persecuted Christian Minority" হিসেবে তাদের উপস্থাপন করে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
- সম্পর্ক: চিন ব্রাদারহুড আরাকান আর্মির সাথে যৌথ সামরিক অভিযানে অংশ নিলেও, তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোতে NUG-কে বৈধ কেন্দ্রীয় সরকার হিসেবে মনে করে।
চিন রাজ্যের ৮৫-৯০% খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয় তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। পশ্চিমা সমর্থন তাদের আর্থিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করেছে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সমুদ্রপথের অভাব। চিন রাজ্য সমুদ্রপথবিহীন (Landlocked) হওয়ায় বাণিজ্য, সামরিক রসদ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তারা ভারত বা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হবে। এটি তাদের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে দুর্বল করে।
অন্যান্য অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
অন্যান্য অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতিও বোঝা জরুরি কারণ এগুলো রাখাইন ও চিন রাজ্যের স্বাধীনতার সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত।
- কাচিন রাজ্য (KIA): কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি লাও সাই, হপাকান্তের জেড-খনি এবং সাদোন পর্যন্ত ‘ওয়ার জোন-১’ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা চীনা সীমান্ত বাণিজ্য পয়েন্ট ব্যবহার করে অস্ত্র ও জ্বালানি সরবরাহ করে। তবে ২০২৪ সালে চীন সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় তাদের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে।
- কারেন রাজ্য (KNLA/KNU): কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে Myawaddy-Maesot সেতু দখল করেছে। তারা ‘Kawthoolei Federal State’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনড়। তবে ডেমোক্র্যাটিক ক্যারেন Buddhist Army (DKBA) জান্তার মিত্র হিসেবে কাজ করছে, যার ফলে এই অঞ্চলে সংঘর্ষ তীব্র হয়েছে।
- উত্তর শান (3BA + UWSA): থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স অপারেশন ১০২৭-এর পর Lashio-Muse হাইওয়ে দখল করেছে। UWSA একটি ডি-ফ্যাক্টো ‘Wa State’ পরিচালনা করে, যেখানে তারা নিজস্ব ইয়ুয়ান মুদ্রা ও চীনা মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করেছে। চীন এই অঞ্চলে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
- সাগাইং-ম্যাগওয়ে (PDF/NUG): এই অঞ্চলে জান্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। আরাকান আর্মি এখানে PDF-কে আর্টিলারি সহায়তা দিচ্ছে। জান্তা বিমান হামলা চালালেও পশ্চিমা দেশগুলো স্যাটেলাইট ডেটা দিয়ে বিদ্রোহীদের সতর্ক করছে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও সংঘর্ষ
বর্তমানে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সেনা জান্তার বিরুদ্ধে আপাতভাবে ঐক্যবদ্ধ হলেও, তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল ও ভঙ্গুর। উদাহরণস্বরূপ, আরাকান আর্মি (AA) এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA)-এর মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছে (২০২০–২১ সালে), যার মূল কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও নাগরিকত্বের প্রশ্ন। AA-র লক্ষ্য বৌদ্ধ-রাখাইন স্বায়ত্তশাসন, যা ARSA-র রোহিঙ্গা মুসলিম স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
অন্যদিকে, চিন ব্রাদারহুড-এর সাথে AA-এর সামরিক সমঝোতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লক্ষ্য ভিন্ন। চিন রাজ্য ধর্মীয় ভিত্তিতে (খ্রিস্টান) ফেডারেল রাষ্ট্র চাইলেও AA পুরোপুরি স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। ভবিষ্যতে এই দুটি গোষ্ঠীর মধ্যেও বিরোধের সম্ভাবনা প্রবল।
কারেন (KNLA/KNU) এবং কাচিন (KIA) গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কৌশলগত এবং অস্থায়ী। তারা NUG-এর সাথে যুক্ত হলেও, দীর্ঘমেয়াদি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোতে কোন অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন কতটুকু হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে।
মিয়ানমারের ২০২৫ সালের পরিস্থিতি একটি বিভক্ত ও অস্থিতিশীল দেশের চিত্র তুলে ধরে। সেনা জান্তার ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, আর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্বশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। রাখাইন ও চিন রাজ্য এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, কারণ তাদের স্বাধীনতার সম্ভাবনা এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
নিচের অংশে আমরা রাখাইন ও চিন রাজ্যের স্বাধীনতার সম্ভাবনা, তাদের শক্তি-দুর্বলতা, এবং ভারত, চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ কি তা বুঝার চেষ্টা করবো।
রাখাইন রাজ্য: স্বাধীনতার সম্ভাবনা ও শক্তি-দুর্বলতা
রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আমরা এর শক্তি ও দুর্বলতা বিশ্লেষণ করব।
শক্তি
- সমুদ্রপথের সুবিধা: রাখাইন রাজ্যের সিত্তওয়ে, কিয়াউকফিউ ও ক্যাপ্টেন বন্দরগুলো এর সরাসরি সমুদ্রপথ নিশ্চিত করে। এটি বাণিজ্য, রসদ সরবরাহ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Kaladan Transit Corridor-এর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ এই সুবিধাকে আরও শক্তিশালী করে।
- স্থানীয় সমর্থন ও শাসন ব্যবস্থা: আরাকান আর্মি (AA) "Arakan People’s Authority" নামে একটি কার্যকর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। স্থানীয় বৌদ্ধ-রাখাইন জনগোষ্ঠী AA-কে একটি বিকল্প প্রশাসন হিসেবে গ্রহণ করেছে। নতুন ট্যাক্স পোলিসি, আদালত ও পুলিশ বাহিনী তাদের শাসনকে স্থিতিশীল করেছে।
- বিদেশি সমর্থন: ভারত এবং চীন উভয়ই রাখাইনের স্বাধীনতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে। ভারতের Kaladan Project এবং চীনের China-Myanmar Economic Corridor (CMEC) রাখাইনের বন্দরের ওপর নির্ভরশীল, যা AA-কে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তা দিচ্ছে।
- সামরিক শক্তি: AA-এর কাছে আধুনিক অস্ত্র (যেমন, ড্রোন ও রকেট লঞ্চার) রয়েছে, যা তাদের সেনা জান্তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করছে। ২০২৪ সালে AA-এর Paletwa অভিযানে জান্তার ৫০০+ সৈন্য হতাহত হয়েছিল।
দুর্বলতা
- রোহিঙ্গা ইস্যু: রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি একটি বড় সমস্যা। AA তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদানে অনিচ্ছুক, যা পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০২০-২১ সালে AA ও ARSA-এর মধ্যে সংঘর্ষ এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করেছে।
- অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা: AA-এর অর্থনৈতিক কাঠামো এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। তারা ট্যাক্স ও প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন, গ্যাস) থেকে রাজস্ব আদায় করছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে সংযোগের অভাব তাদের বাণিজ্যকে সীমিত করছে।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: রাখাইনের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে বিস্ময়ের মধ্যে রয়েছে। যদিও ভারত ও চীন সমর্থন করে, পশ্চিমা দেশগুলো (US, EU) এটিকে "জাতিগত বিভ্রান্তি" হিসেবে দেখছে, যা UN-এর সমর্থন পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করবে।
স্বাধীনতার সম্ভাবনা (রাখাইন):
রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা টিকে থাকার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, এর সরাসরি সমুদ্রপথ ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে আরাকান আর্মিকে পশ্চিমা সমর্থন পেতে হলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে নমনীয় হতে হবে।
চিন রাজ্য: স্বাধীনতার সম্ভাবনা ও শক্তি-দুর্বলতা
চিন রাজ্য, যা রাখাইনের উত্তরে অবস্থিত, একটি ভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা চায়।
শক্তি
- ধর্মীয় একতা: চিন রাজ্যের জনসংখ্যার ৮৫-৯০% খ্রিস্টান, যা তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে একটি ধর্মীয় আবেগ দিয়েছে। Chin Brotherhood Alliance এই একতাকে কাজে লাগিয়ে "Chinland Interim Council" গঠন করেছে।
- পশ্চিমা সমর্থন: খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠন ও পশ্চিমা এনজিও (যেমন, World Vision) এই অঞ্চলে মানবিক সাহায্য ও আর্থিক সমর্থন দিচ্ছে। US-এর "International Religious Freedom Act" চিন জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করার একটি মাধ্যম হতে পারে।
- সামরিক সহযোগিতা: চিন ব্রাদারহুড আরাকান আর্মির সাথে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে, যা তাদের সামরিক ক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। ২০২৪ সালে তাদের Mindat অভিযানে জান্তার কয়েকটি ক্যাম্প ধ্বংস করা হয়েছে।
- স্থানীয় শাসন: তাদের ফেডারেল সংবিধানের খসড়া ও গ্রামীণ শিক্ষা-স্বাস্থ্য বোর্ড তাদের শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে।
দুর্বলতা
- সমুদ্রপথের অভাব: চিন রাজ্য সমুদ্রপথবিহীন (Landlocked), যা এর স্বাধীনতার বড় বাধা। এটি বাণিজ্য ও রসদের জন্য ভারত (মিজোরাম) বা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হবে, যা কৌশলগতভাবে দুর্বলতা সৃষ্টি করবে।
- অর্থনৈতিক ভিত্তির অভাব: চিন রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল। প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন, কাঠ) সীমিত, এবং পশ্চিমা সাহায্যই এর প্রধান উৎস, যা স্থিতিশীল নয়।
- ভারতের বিরোধিতা: ভারত চিন রাজ্যের স্বাধীনতাকে প্রতিরোধ করছে, কারণ এটি মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে পারে।
- আন্তর্জাতিক চাপ: পশ্চিমা সমর্থন থাকায় UN-এর স্বীকৃতি পাওয়া সহজ তবে ভারতের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। চীনও এক্ষেত্রে প্রতিবন্দক হবে।
স্বাধীনতার সম্ভাবনা (চিন):
চিন রাজ্যের স্বাধীনতার সম্ভাবনা দুর্বল, প্রধানত সমুদ্রপথের অভাব ও ভারতের বিরোধিতার কারণে। আর একক ভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সেক্ষেত্রে তাকে ফেডারেল সরকারের পথে যেতে হবে অন্যান্য রাজ্য গুলো নিয়ে।
আর সেক্ষেত্রে মিজোরাম, মনিপুর এবং নাগাল্যান্ড সংযুক্ত হতে পারে (এরা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভাবে এক হতে চাইবে) আবার মায়ানমারের কাচিন রাজ্যও যুক্ত হতে পারে।
এছাড়া যদি পশ্চিমা দেশগুলো এটিকে একটি "খ্রিস্টান রিফিউজ" হিসেবে প্রচার করে এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে সমুদ্রপথ নিশ্চিত করতে পারে, তবে স্বাধীনতা অসম্ভব নয়!
ভারত, চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ
ভারতের স্বার্থ
- রাখাইন সমর্থন: ভারত রাখাইনের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে কারণ এটি Kaladan Corridor-এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ নিশ্চিত করবে। ২০২৩ সালে ভারত আরাকান আর্মিকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ শুরু করেছে।
- চিন বিরোধিতা: চিন রাজ্যের স্বাধীনতা ভারতের জন্য হুমকি, কারণ এটি মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে জ্বালিয়ে তুলতে পারে। ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম আরাকান আর্মির হাতে দিয়ে চিনকে সমুদ্রপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
- কৌশলগত উদ্বেগ: ভারত চায় না যে চিন রাজ্য পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে আসুক, কারণ এটি তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে।
চীনের স্বার্থ
- CMEC এবং বন্দর: চীন রাখাইনের সিত্তওয়ে বন্দরের মাধ্যমে CMEC প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, যা তাদের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের পথ খুলবে। চীন আরাকান আর্মিকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে।
- চিন রাজ্যে নিরপেক্ষতা: চীন চিন রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই এটির স্বাধীনতা নিয়ে তারা উদাসীন। তবে যদি চিন রাজ্য পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে চীন এটিকে বাধা দেবে।
- সীমান্ত নিরাপত্তা: চীন চায় না যে মিয়ানমারের সংকট তাদের সীমান্তে (উত্তর শান, কাচিন) অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তাই তারা UWSA-এর মাধ্যমে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রাখছে।
পশ্চিমা দেশগুলো (US, EU)
- চিন সমর্থন: পশ্চিমা দেশগুলো চিন রাজ্যের স্বাধীনতাকে "খ্রিস্টান রিফিউজ" হিসেবে দেখছে। US-এর USAID ও EU-এর ECHO চিনে মানবিক সাহায্য দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কমানো।
- রাখাইনের বিরোধিতা: পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না কারণ AA-এর রোহিঙ্গা-বিরোধী নীতি তাদের মানবাধিকার এজেন্ডার সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে।
- কৌশলগত লক্ষ্য: পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারকে একটি ফেডারেল স্টেট হিসেবে দেখতে চায়, যাতে তারা চীনের বিরুদ্ধে একটি ভূ-রাজনৈতিক সুযোগ পায়।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের ধরন ও সীমাবদ্ধতা
জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পেছনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন রয়েছে, যা প্রধানত তিন ধরনেরঃ অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক।
- ভারত রাখাইনে Kaladan প্রকল্প সুরক্ষার জন্য AA-কে সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু চিন রাজ্যে ভারতের অবস্থান সতর্কতামূলক, কারণ এটি তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
- চীন CMEC প্রকল্প বাস্তবায়নে রাখাইনে AA-কে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেয়। তবে চীন সীমান্তবর্তী কাচিন ও শান রাজ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য UWSA-র মাধ্যমে কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে।
- পশ্চিমা দেশগুলোর (US, EU) সাহায্য একই সাথে মানবিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক। তারা চিন রাজ্যের খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু সামরিক সাহায্য সীমিত এবং মূলত কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই তারা প্রভাব বিস্তার করছে।
এই সমর্থনের সীমাবদ্ধতা হলো, কোনো আন্তর্জাতিক শক্তিই সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে যেতে চায় না, বরং তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী একে অপরের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে ভূরাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করছে।
আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করতে নারাজ কারণ এতে বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে চীন ও ভারত সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে চায় না, এবং পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের ভূমিকা মানবিক ও কূটনৈতিক চাপে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার সম্ভাবনা বেশি কারণ এর সমুদ্রপথ ও বিদেশি সমর্থন। তবে রোহিঙ্গা ইস্যু ও আন্তর্জাতিক চাপ এটিকে জটিল করবে। চিন রাজ্যের স্বাধীনতা দুর্বল, প্রধানত সমুদ্রপথের অভাব ও ভারতের বিরোধিতার কারণে।
ভারত ও চীন রাখাইনকে সমর্থন করে, কিন্তু চিন রাজ্যে তাদের স্বার্থ ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলো চিনকে সমর্থন করে, কিন্তু রাখাইন এর ক্ষেত্রে সতর্ক।
তবে মায়ানমার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবে?
মায়ানমারে এই মুহূর্তে ৫ টি অঞ্চল জান্তার হাত থেকে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর একটি অঞ্চল কে কেন্দ্র করে তীব্র লড়াই চলছে (সাগাইং-ম্যাগওয়ে রাজ্যে) প্রত্যেকের নিজস্ব লক্ষ ও উদ্দেশ্য আছে এবং প্রত্যেকে স্বায়ত্তশাসন, নিজস্ব সংবিধান, পতাকা, প্রশাসনিক কাঠামো নিজেদের মতো করে করছে।
এই অবস্থায় মায়ানমার ভেঙ্গে কয়েক টুকরা হয়ে কয়েকটি দেশের জন্ম হতে পারে (যদিও তাদের টিকে থাকা অসম্ভব হবে 'ডিরেক্ট সী একসেস' না থাকলে)।
নিচে মায়ানমারকে বিদ্রোহী গ্রুপ যেসব রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভেদে মানচিত্রঃ

বিদ্রোহী গ্রুপ গুলোর মধ্যে যদি কোনো ধরণের ঐক্য না ঘটে, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত, মিয়ানমার থেকে ৫টা আলাদা দেশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেঃ
- চিনল্যান্ড
- আরাকান
- কাচিন
- কাওথুলেই
- শান

উপরে দেওয়া মানচিত্র একটু ভালো ভাবে খেয়াল করলে দেখবেনঃ
১। কাচিন ও শান অঞ্চল চীনের সাথে বর্ডার শেয়ার করে।
২। আরাকান বাংলাদেশের সাথে বর্ডার এবং সরাসরি সমূদ্রে এ্যাকসেস।
৩। চিনল্যান্ড বাংলাদেশ ও ভারতের মিজোরামের সাথে বর্ডার শেয়ার করে।
আলাদা দেশ হতে গেলে অন্য দেশগুলোর সম্মতি লাগে। সুতরাং, ৫ টি আলাদা দেশ হওয়া যেমন কঠিন একই সাথে ডিরেক্ট সী এ্যাক্সেস ব্যতিত সেই দেশের টিকে থাকাও অসম্ভব।
একসঙ্গে থাকার উপায় আছে কি?
আলাদা দেশ না হয়ে এই গোষ্ঠীগুলো একটা “ফেডারেল ইউনিয়ন/স্টেট” বানাতে পারে। এর মানে হলো, সবাই একটা বড় দেশের মধ্যে থাকবে, কিন্তু নিজেদের এলাকায় নিজেদের নিয়ম চালাতে পারবে।
উদাহরণ: আমেরিকার মতো। আমেরিকায় অনেক রাজ্য আছে, প্রত্যেকের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে, তবু সবাই একটা দেশের অংশ। মিয়ানমারেও এমন হতে পারে।
ফেডারেল স্টেট গঠনের বাস্তবিক জটিলতা ও সম্ভাব্যতা
ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনে সমস্যাসমূহ:
- রাজনৈতিক ও জাতিগত স্বার্থের পার্থক্য
- স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা নিয়ে মতবিরোধ
- কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী ও রাজস্ব বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব
- বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোতে ভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো
মিয়ানমারে ফেডারেল স্টেট গঠনের ধারণাটি রাজনৈতিকভাবে খুব আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু বড় বাধা রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের পার্থক্য।
AA রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, অন্যদিকে চিন ব্রাদারহুড একটি খ্রিস্টান ফেডারেশন তৈরি করতে আগ্রহী।
একইভাবে KIA ও KNLA-র লক্ষ্যেও পার্থক্য রয়েছে, যার ফলে ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফেডারেল কাঠামো নির্মাণ প্রায় অসম্ভব।
তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী ও রাজস্ব আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন।
বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যেই আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের সাথে মেলানো কঠিন হবে।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা
কিছু গোষ্ঠীর প্রতিবেশী দেশের (যেমন ভারত, বাংলাদেশ, চীন) সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতির মিল আছে। তারা চাইলে সেসব দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু এটা খুব জটিল।
উদাহরণ: ধরুন, আপনি আপনার পাশের বাড়ির সঙ্গে এক হতে চান। কিন্তু তারা যদি না চায় বা আইন না মানে, তাহলে কীভাবে হবে? এখানেও তাই।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে, রাখাইন ছাড়া আর কেউই সেভাবে টিকে থাকতে পারবে না। আবার প্রতিটি বিদ্রোহী গ্রুপ নিজ নিজ জাতি'র প্রতিনিধিত্ব করছে আর নিজস্ব লক্ষ ও উদ্দেশ্যে লড়াই করছে। সুতরাং, ফেডারেল ইউনিয়ন দুঃসাধ্য! এমন পরিস্থিতিতে তাদের সামনে ধর্মের ভিত্তিতে জোটবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অন্যথায়, সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি হবে মায়ানমারের।
যদি ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন হয়, তাহলে পরিস্থিতি কি হতে পারে তা আলোচনা করা যাক।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ও পার্বত্য অঞ্চলের ঝুঁকি
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাণকেন্দ্র, যেখানে মিলেছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত — সেই পার্বত্য অঞ্চলগুলো আজ এক জটিল ভূরাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় পরিচয়, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য এবং বিদেশি স্বার্থের জটিল ছকে এ অঞ্চল তিনটি সম্ভাব্য ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোচ্ছে, যা এই পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
ধর্মীয় ভিত্তিতে সম্ভাব্য রাষ্ট্রসমূহের বিস্তারিত
অঞ্চল | দখল হার* | প্রধান দখলদার | ধর্মীয় প্রোফাইল | বিদেশি সমর্থন |
---|---|---|---|---|
রাখাইন | ≈ ৮০ % | আরাকান আর্মি (AA) | বৌদ্ধ ৭০ %, রোহিঙ্গা মুসলিম ২০ % | ভারত (মনিপুর-মিজোরাম-নাগাল্যান্ড কে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে), চীনা অস্ত্র, পশ্চিমা মানবিক সহায়তা |
চিন | ≈ ৮৫ % | Chin Brotherhood Alliance (CDF/CNDF) | খ্রিস্টান ৯২ % | ভারত সীমান্ত‑লজিস্টিক, ইউরোপ‑মার্কিন এনজিও |
কাচিন (উত্তর‑মধ্য) | ≈ ৬৫ % | KIA | খ্রিস্টান ৩৪ %, বৌদ্ধ ৬৪ % | চীনা অস্ত্র করিডোর, কাচিন ডায়াসপোরা |
কারেন পূর্ব সীমান্ত | ≈ ৬০ % | KNLA / KNU | বৌদ্ধ‑খ্রিস্টান মিশ্র | থাই লজিস্টিক, পশ্চিমা ENGO |
উত্তর শান | ≈ ৭৫ % | 3BA (MNDAA‑TNLA‑AA) + UWSA | বৌদ্ধ + চীনাপ্রধান | স্থিতিশীলতা‑সাপেক্ষ চীন |
সাগাইং‑ম্যাগওয়ে গ্রামীণ | ≈ ৫০ % | NUG/PDF | বামার বৌদ্ধ | যুক্তরাষ্ট্র USD 400 M অ‑প্রাণঘাতী |
জান্তা কোর | ১০০ % | SAC (Tatmadaw) | বৌদ্ধ মেজর | চীন‑রাশিয়া অস্ত্র, কূটনৈতিক ভেটো |
*দখল হার ≈ মোট টাউনশিপ সংখ্যার আনুপাতিক নিয়ন্ত্রণ।
ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভূগোলিক অবস্থান এর উপর ভিত্তি করে ৩ টি রাস্ট্রের সম্ভাবনাঃ
- Zomi–Christian Federation (ZCF)
- CKK Upland Republic
- Arakan–Parbatya Buddhist Confederacy (APBC)
Zomi–Christian Federation (ZCF)

ZCF গঠনের প্রস্তাবিত অঞ্চলগুলো হলো মিয়ানমারের Chin State, ভারতের Mizoram, Nagaland, Manipur Hills। অতীতে কিছু গবেষণায় বাংলাদেশের বান্দরবানের খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল (যেমন খুমি বা ম্রো সম্প্রদায়ের কিছু অংশ) যুক্ত করার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র বলছে—বান্দরবান মূলত রাখাইন বৌদ্ধ বলয়ের অংশ হয়ে পড়েছে।
ZCF এলাকাজুড়ে প্রায় ৮৫–৯০% খ্রিস্টান, এবং জাতিগতভাবে Zomi, Mizo, Kuki ও Naga গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। এসব অঞ্চলে Chin National Front (CNF) ও Chin Brotherhood বেশ সক্রিয়, যারা নিজেদের ধর্ম ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র চায়।
ভারত সরকার এই অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করলেও, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাতে 'সফট সাপোর্ট' দিয়ে থাকে। পশ্চিমা খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠনগুলো এদের “Persecuted Christian Minority” হিসেবে তুলে ধরে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
তবে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো—ZCF হবে Landlocked, অর্থাৎ এর কোনো সমুদ্রপথ থাকবে না। ফলে বাণিজ্য, সামরিক রসদ, কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ভারতই হয়ে উঠবে একমাত্র করিডোর, যা একে সবসময় ভূরাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখবে। সেক্ষেত্রে এই দেশটির হয় পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে করিডোর নিতে হবে অন্যথা রাখাইন/আরাকান রাজ্যের উপর দিয়ে। আর ধর্মের ভিত্তিতে যদি ভাগ হয়, সেক্ষেত্রে রাখাইন হবে একটি স্বাধীন দেশ (আরাকান)।
CKK Upland Republic

এই রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত অঞ্চলসমূহ হলো মিয়ানমারের Kachin, Kayah, Kayin State এবং Northern Shan State-এর কিছু অংশ। এই এলাকায় ৬০–৭০% খ্রিস্টান, বিশেষত Kachin, Karen, Karenni গোষ্ঠী, যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে Kachin Independence Army (KIA), Karen National Union (KNU) এবং Karenni Army (KA)।
এই দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং National Unity Government (NUG)-এর সাথে যুক্ত রয়েছে। চীন এই অঞ্চলটিকে সেনা ভুমির প্রতিবেশী হিসেবে দেখে এবং সেখানে সীমান্ত বাণিজ্য ও অস্ত্র সরবরাহ করে AA বা KIA-এর মতো গোষ্ঠীদের পরোক্ষভাবে সহায়তা দেয়।
পশ্চিমারা এখানকার খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল। মিশনারি সংস্থা ও মানবাধিকার গোষ্ঠী নিয়মিত আর্থিক সহায়তা ও NGO প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু এ রাষ্ট্রের দুর্বলতা একই রকম—এটিও সম্পূর্ণ Landlocked। ফলে এতে আন্তর্জাতিক লজিস্টিক ও বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ থাকবে, এবং জান্তা বাহিনীর ঘেরাও ও ভারত–চীনের দ্বৈরথের মাঝে পড়ে যেতে পারে। সেরকম পরিস্থিতিতে তাদেরকে উপকুলের রাজ্যটিকে দখল করতে হবে।
Arakan–Parbatya Buddhist Confederacy (APBC)

এই রাষ্ট্র গঠনের মূল কাঠামো গড়ে উঠছে মিয়ানমারের Rakhine State, ভারতের Lawngtlai (দক্ষিণ মিজোরাম) এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম (বিশেষত রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি)-কে ঘিরে। রাখাইন অঞ্চলে Arakan Army (AA) শক্তিশালীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই অঞ্চল ধর্মীয়ভাবে ৬০% বৌদ্ধ ও ৩৫% রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, খিয়াং—এই সব জাতিগোষ্ঠী মূলত বৌদ্ধ, এবং এদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি রাখাইন বৌদ্ধদের সাথে মিলে যায়। বান্দরবানও বর্তমানে AA-এর কৌশলগত দৃষ্টিতে রয়েছে, কারণ এটি রাখাইন থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ‘সংযোগ করিডোর’ হিসেবে কাজ করতে পারে।
Arakan Army রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ARSA ও AA ২০২০–২১ সালে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়াতে AA এখন সহাবস্থানের কৌশল নিচ্ছে।
এই অঞ্চলেই রয়েছে চীনের বিশাল CMEC প্রকল্প – কুনমিং থেকে শুরু হয়ে মান্দালয় ও রাখাইন হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায়, যার অংশ সিত্তওয়ে সমুদ্রবন্দর। ভারতও Kaladan Multi-modal Transit Transport Project বাস্তবায়ন করছে, যার মাধ্যমে তারা কলকাতা থেকে সিত্তওয়ে হয়ে মিজোরামে পণ্য পাঠাচ্ছে।
এবং এখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্য – APBC একমাত্র রাষ্ট্র, যার নিজস্ব সমুদ্রবন্দর থাকবে, যা তাকে একটি আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর ও টিকে থাকার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ঝুঁকি:
ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন হলে দীর্ঘমেয়াদে অঞ্চলটি সিরিয়া বা আফগানিস্তানের মতো দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা ও জাতিগত সংঘর্ষের দিকে যেতে পারে। বিশেষত ZCF এবং CKK Landlocked হওয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়বে এবং ভূ-রাজনৈতিক বিরোধের সম্ভাবনা প্রবল হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি
Arakan Army যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িকে নিজেদের রাষ্ট্রের অংশে পরিণত করে, তাহলে বাংলাদেশ তার গুরুত্বপূর্ণ উচ্চভূমি, কৌশলগত পাহাড়ি অঞ্চল এবং সীমানা নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
আমার মতে, ভারত এক্ষেত্রে সাহায্য করবে যেন ৩ পার্বত্য জেলা আরাকান আর্মি দখলে নেয়। এতে করে ভারতের ৩ টি স্টেট ও চিন রাজ্য নিয়ে যে খৃস্টান রাষ্ট্র Zomi–Christian Federation (ZCF) এর কথা একটু আগে আলোচনা করেছি, সেটি Landlocked হয়ে পড়বে।
ভারতের জন্যও এটি লাভজনক—একদিকে তারা খ্রিস্টান বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাতে পারবে, অন্যদিকে APBC গঠনের মাধ্যমে Kaladan Corridor সুরক্ষিত করবে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
এদিকে যদি APBC গঠিত হয়, তবে ZCF ও CKK কখনোই সমুদ্রপথ পাবে না। এর অর্থ—সেসব রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই মরে যাবে।
তিনটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রই কোনো না কোনো রাজনৈতিক শক্তি ও বিদেশি সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। তবে কেবল Arakan–Parbatya Buddhist Confederacy (APBC) তার ভৌগোলিক অবস্থান ও সমুদ্রপথের প্রবেশাধিকার থাকার কারণে একটি কার্যকর ও টিকে থাকার মতো রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
এটি শুধু মিয়ানমার নয়—বাংলাদেশের জন্যও সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি, কারণ এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম হারানোর সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে।
যদি রাখাইন বা চিন রাজ্যের স্বাধীনতা না ঘটে, তাহলে সেনা জান্তার পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠা বা দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে পরিস্থিতি মোড় নিতে পারে। এতে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতায় পড়বে, যা প্রতিবেশী বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করবে।
রাখাইনকে ঘিরে ভারত, চীন ও পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক খেলা
রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত ও চীনের সমর্থনের পিছনে রয়েছে তাদের নিজ নিজ কৌশলগত স্বার্থ। ভারতের Kaladan Multi-modal Transit Project এবং চীনের China-Myanmar Economic Corridor (CMEC) উভয়ই রাখাইনের সমুদ্রবন্দরের উপর নির্ভরশীল।
ফলে, উভয় দেশই রাখাইনের স্বাধীনতা বা অন্তত শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে। আরাকান আর্মি (AA)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখাইন থাকলে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে নিরাপদ সংযোগ বজায় রাখতে পারে এবং চীন বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রবেশের কৌশলগত সুবিধা পায়।
কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) রাখাইনের এই সম্ভাব্য স্বাধীনতা বা শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে।
পশ্চিমারা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করতে এই অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ দেখতে পাচ্ছে।
আর এর জন্য তারা রোহিঙ্গা কার্ড ব্যবহার করে আরাকান আর্মিকে (AA) চাপের মুখে রাখছে।
পশ্চিমারা AA-এর নিয়ন্ত্রণাধীন রাখাইন অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে AA-এর অনাগ্রহকে সামনে এনে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করছে। এতে AA-এর ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর এক ধরনের পাওয়ার ব্যালেন্সিং সৃষ্টি হয়েছে।
পশ্চিমাদের এই চাপ ও দর কষাকষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জাতিসংঘ, OIC ও পশ্চিমা দেশগুলোর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন।
ডঃ ইউনূস পশ্চিমা সমর্থন ও আন্তর্জাতিক চাপের বিনিময়ে যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র (বিশেষত আরাকান বা চিনল্যান্ড) গঠনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে রাখছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি।
এটি AA ও চিন ব্রাদারহুড উভয় পক্ষকেই একটি জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে ডঃ ইউনূসের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন ও চাপ প্রয়োগ করে ভারতের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতাকে প্রতিহত করছে।
অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা AA-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো কৌশলগত অঞ্চলগুলো দখল করার পরিকল্পনা করছে।
AA এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
ভারতের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে রাখাইনকে স্থিতিশীল রাখা, একই সাথে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দুর্বল করা।
তাই মিয়ানমারের এই ভূ-রাজনৈতিক খেলার কেন্দ্রে রয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যু। পশ্চিমারা একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে AA-কে নিয়ন্ত্রণের জন্য, অন্যদিকে ভারত-চীন AA-কে শক্তিশালী রাখতে নিরব ভূমিকা পালন করছে।
এই পরিস্থিতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে, যেখানে রাখাইনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সমগ্র অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎ।
আপডেটঃ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
ভারত এই জটিল পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যদি কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন করার প্রশ্ন ওঠে, তবে ভারতের সম্ভবত খ্রিস্টান বা মুসলিম গোষ্ঠীর প্রতি আগ্রহ থাকবে না। এই প্রেক্ষাপটে একমাত্র অবশিষ্ট শক্তিশালী বৌদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী হলো আরাকান আর্মি।
কিন্তু, ভারত এতদিন মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। মায়ানমারের সিটওয়ে বন্দর কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের অংশ, যা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মিজোরামকে মায়ানমারের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ভারতের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক একীকরণ বৃদ্ধি করা। এটি সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়।
ভারতের কলকাতা বন্দর থেকে মায়ানমারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে স্থলপথ bypass করে কার্গো কালাদান নদী হয়ে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ শহর পালেতোয়ায় পরিবহন করা হয়। পালেতোয়া থেকে একটি সড়ক করিডোর ভারতের মিজোরাম সীমান্তের সাথে সংযুক্ত, যা সরাসরি প্রবেশাধিকার প্রদান করে। এই লিঙ্কটি সমুদ্র, নদী ও সড়ক পরিবহন ব্যবহার করে বহুমুখী সংযোগ সম্পন্ন করে। এই করিডোরটি মূলত মায়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই বছরের অর্থাৎ ২০২৫ এর মার্চ মাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে,
একজন ভারতীয় সংসদ সদস্য মায়ানমারে আরাকান আর্মির প্রতিনিধিদের সাথে একটি নদী অবকাঠামো প্রকল্প সম্পন্ন করার বিষয়ে বৈঠক করেন। যদিও বৈঠকের আলোচ্যসূচি মূলত প্রকল্পকেন্দ্রিক ছিল, তবে এর বাইরে অন্য কোনো আলোচনা হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ত
বে, ভারত সরকার কেন সরাসরি মায়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে আলোচনা না করে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে এই মুহূর্তে আরাকান আর্মি মায়ানমারের সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি মূল্যবান, অন্তত মায়ানমারের এই অংশে।
আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোপনে আরাকান আর্মি এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে আলোচনার জন্য নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই আমন্ত্রণপ্রাপ্ত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ছিল জাতীয় ঐক্য সরকার (National Unity Government), আরাকান আর্মি, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (Chin National Front) এবং চিন ব্রাদারহুড (Chin Brotherhood)। ভারত সরকার এই প্রতিটি গোষ্ঠীর সাথে পৃথকভাবে বৈঠক করেছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে (অর্থাৎ শেখ হাসিনা'র পতনের পরপর) ভারত সরকার উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আলোচনার জন্য দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে আরাকান আর্মি সম্ভবত নীরবে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। যা খুব সম্ভবত পশ্চিমাদের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ! একই সাথে বাংলাদেশের জন্যেও!
References:
- BBC: https://www.bbc.com/news/articles/c390ndrny17o
- Progressive Voice: https://progressivevoicemyanmar.org/2024/05/30/briefing-paper-effective-control-in-myanmar-2024-update/
রাখাইন রাজ্য ও আরাকান আর্মি (AA): রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (AA) প্রায় ৮০% এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ১৭টির মধ্যে ১০টি টাউনশিপে তাদের পূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামো চালু রয়েছে। তারা স্থানীয় আদালত, কর সংগ্রহ এবং নিরাপত্তা বলয় পরিচালনা করছে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে তারা বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর দখল করে সীমান্তের প্রায় ২৭০ কিমি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আনে।
সূত্র:
- RFA: https://www.rfa.org/english/myanmar/2024/11/27/arakan-army-explainer-rakine/
- Irrawaddy: https://www.irrawaddy.com/news/war-against-the-junta/aa-takes-complete-control-of-myanmar-bangladesh-border-after-seizing-maungdaw.html
কাচিন ও শান রাজ্য: কাচিন স্বাধীনতা বাহিনী (KIA) ২০২৪ সালে ৮০টির বেশি সেনা ঘাঁটি দখল করেছে এবং একাধিক বড় শহর (Sumprabum, Bhamo) ঘেরাও করেছে। শান রাজ্যে TNLA ও MNDAA সহকারী ভূমিকা পালন করছে এবং চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে।
সূত্র:
- ACLED: https://acleddata.com/2024/12/09/asia-pacific-overview-november-2024/
- Wikipedia: https://en.wikipedia.org/wiki/Kachin_offensive_(2024%E2%80%93present)
- Irrawaddy: https://www.irrawaddy.com/opinion/analysis/how-china-manipulates-myanmars-ethnic-resistance.html
কায়িন ও কায়াহ রাজ্য: থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী মিয়াওয়াড্ডি শহর KNLA এবং মিত্র PDF বাহিনী ২০২৪ সালের এপ্রিলে দখল করে নেয়। যদিও জান্তা পরে "অং জেয়া অভিযান" চালিয়ে শহরের কিছু অংশ পুনর্দখল করে, কিন্তু সীমান্ত ও আশেপাশের গ্রামীণ এলাকায় এখনও বিদ্রোহীদের দখল বজায় আছে।
সূত্র:
- The Diplomat: https://thediplomat.com/2024/04/ethnic-karen-rebels-complete-capture-of-strategic-myanmar-border-crossing/
- Irrawaddy: https://www.irrawaddy.com/opinion/analysis/a-closer-look-at-the-battle-for-control-of-myanmars-border-with-thailand.html
সাগাইং, ম্যাগওয়ে ও চিন রাজ্য: PDF বাহিনী এই অঞ্চলে বিকল্প প্রশাসন (Peoples’ Administration Organization) গড়ে তুলেছে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষ অব্যাহত রেখেছে। ২০২৪ সালে সেনাবাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা ও গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। UN রিপোর্টে বলা হয়েছে শুধুমাত্র সাগাইং এলাকায় শত শত গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে।
সূত্র:
- COAR Global: https://www.coar-global.org/2023/09/27/broken-heartland-armed-violence-and-emergency-response-in-central-myanmar/
- ACAPS: https://www.acaps.org/fileadmin/Data_Product/Main_media/20250401_ACAPS_Myanmar_Earthquake_-_Sagaing_pre-crisis_profile.pdf
- CFR: https://www.cfr.org/global-conflict-tracker/conflict/rohingya-crisis-myanmar
আঞ্চলিক শক্তি: ভারত ও চীন: ভারত রাখাইন অঞ্চলের Kaladan প্রকল্প ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা রক্ষায় চিন্তিত। ভারত জান্তা সরকারের সঙ্গে পাশাপাশি বিদ্রোহী নেতাদের সাথেও নীরবে সম্পর্ক বজায় রাখছে।
সূত্র:
- Observatorio: https://boletinderechoshumanos.wordpress.com/2025/04/11/a-rebel-border-indias-evolving-ties-with-myanmar-after-the-coup/
- Preprints: https://www.preprints.org/manuscript/202505.1154/v1/download
চীন জান্তা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে বিনিয়োগ ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তারা TNLA ও MNDAA-কে সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে আনতে সক্ষম হয়েছে।
সূত্র:
- Irrawaddy: https://www.irrawaddy.com/opinion/analysis/how-china-manipulates-myanmars-ethnic-resistance.html
- BBC: https://www.bbc.com/news/articles/ckg324den6po
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন NUG ও গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে মানবিক সহায়তা দিচ্ছে এবং জান্তা সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করছে। সরাসরি অস্ত্র নয়, বরং ত্রাণ, কূটনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক সমর্থনই তাদের মূল অস্ত্র।
সূত্র:
- BTI Project: https://bti-project.org/en/reports/country-report/MMR
- Wilson Center: https://www.wilsoncenter.org/sites/default/files/media/uploads/documents/2024-03_IndoPacificInTheWorld_Myers.pdf
আন্তর্জাতিক এনজিও ও মিশনারি সহায়তা: UN ও বিভিন্ন NGO সীমান্ত দিয়ে খাদ্য ও ওষুধ পাচার করে দিচ্ছে। Christian Aid ও Chin Baptist Church Network চিন ও কাচিন রাজ্যে সহায়তা দিচ্ছে।
সূত্র:
- Guardian: https://www.theguardian.com/world/2018/may/14/slow-genocide-myanmars-invisible-war-on-the-kachin-christian-minority
- COAR: https://www.coar-global.org/2023/09/27/broken-heartland-armed-violence-and-emergency-response-in-central-myanmar/
- ABC-USA: http://www.abc-usa.org/wp-content/uploads/2020/11/BGM-Item-3D-Unprotected-Chin-IDPs-Final.pdf
প্রবাসী সহায়তা: বিদেশে থাকা মিয়ানমার প্রবাসীরা NUG-কে $১৫৬ মিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য করেছে। তারা ফান্ড রেইজিং, ক্যাম্পেইন ও লবিং কার্যক্রম চালাচ্ছে।
সূত্র:
নোট: এই রিপোর্টে উল্লেখিত তথ্য ও পরিসংখ্যান উল্লিখিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হয়েছে এবং প্রতিটি দাবির পেছনে নির্ভরযোগ্য উৎসের লিংক সংযুক্ত করা হয়েছে।