পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, পুনর্বাসন, আর এক রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড

এটা একদমই সাদামাটা লেখা।
যার অনেক কিছু আপনি হয়তো জানেন—খবরের পাতায় পড়েছেন, টকশোতে শুনেছেন, কখনও হয়তো পাশের কাউকে বলতে শুনেছেন।
তবে এটা শুরু মাত্র—এক দীর্ঘ অনুসন্ধানের, এক অনালোচিত ইতিহাসের, যা এতদিন আমাদের চোখের সামনেই ছিল, অথচ আমরা দেখিনি!
গত ২৩ দিন ধরে আমি ডুবে ছিলাম এক ভূখণ্ডের অদেখা ইতিহাস, নীরব সংঘাত আর দুর্লভ সংযোগ খুঁজে পেতে—পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে ভারতের সেভেন সিস্টার্স, তারপর মিয়ানমারের গহীন পাহাড় ঘিরে।
যত সামনে এগিয়েছি, ততই মনে হয়েছে—এখানে কিছু আছে, যা কাগজে লেখা নেই, কিন্তু ভূগোলে দাগ কেটে গেছে।
এই লেখায় আপনি এমন কিছু জানতে চলেছেন, যা একদিকে অতীতের অজানা প্রেক্ষাপট খুলে দেবে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মানচিত্র নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে।
ধর্ম, ভূরাজনীতি, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সব এক বিন্দুতে এসে মিশেছে।
আর সেই বিন্দুটি ঠিক কোথায়, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ—তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে প্রতিটি পর্বে।
শুধু চোখ দিয়ে নয়—মস্তিষ্ক দিয়ে পড়ুন। কারণ এখানে যা বলা হবে, তার পেছনে আরও অনেক কিছু বলা হয়নি!
আর যেটা বলা হয়নি, সেটাই আপনাকে ভাবাবে সবচেয়ে বেশি।
চলুন, শুরু করি—একটি প্রশ্ন থেকে, যার উত্তর খুঁজতে গেলে, হয়তো একদিন আপনি নিজেই প্রশ্ন হয়ে উঠবেন।
"পার্বত্য চট্টগ্রাম আসলে কার জন্য?"
শুরুটা ছিল ব্রিটিশদের হাতে
১৯৪৭ সালের ঠিক আগে, ব্রিটিশরা গোপনে এক অবাক করা পরিকল্পনা করেছিল—ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ‘ক্রাউন স্টেট’ গঠনের। লক্ষ্য ছিল: একটি বিচ্ছিন্ন, সরাসরি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল যা পরবর্তী কৌশলগত যুগে পশ্চিমাদের জন্য হবে “গেটওয়ে টু ইন্ডো-চায়না।”
কিন্তু ভারতের তীব্র আপত্তি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক চাপে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন—সাথে আমেরিকার নতুন ভূমিকায় আবির্ভাব—এই পরিকল্পনা বাতিল হয়। কিন্তু যা ফাইলচাপা হয়, তা কিন্তু ভূখণ্ড থেকে মুছে যায় না। তার ছায়া রয়ে যায়, ভবিষ্যতের বিস্ফোরণের জন্য।
মিশনারি আগ্রাসন: ধর্মের নামে ধীরে ধীরে জমি দখল
১৯৭০ এর দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান মিশনারিরা বড় আকারে কার্যক্রম শুরু করে। তারা স্কুল, হাসপাতাল, এনজিও খুলে পাহাড়িদের মধ্যে “সহযোগিতা” ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু এটা কেবল মানবসেবা ছিল না—এ ছিল “সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং”-এর সূচনা। ধর্মান্তরিত করার কাজও চলছিল, যদিও শুরুতে সেটা সীমিত ছিল।
তাদের পেছনে ছিল পশ্চিমা দাতা সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিভিন্ন চার্চ-ভিত্তিক সংগঠন, যারা চেয়েছিল এক "খ্রিস্টান মাইনরিটি বাফার জোন"।
১৫ আগস্ট: মঞ্চ বদলায়
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা চলে যান ভারতে। ঠিক তখনই কাকতালীয়ভাবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একজন নিভৃত ব্রিগেডিয়ার—এইচএম এরশাদ—সামরিক কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। পরে তিনিই সেনাপ্রধান হবেন।
অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মঞ্চে আসেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এদিকে মঞ্চে আসেন এম এন লারমা!
এমএন লারমার আবির্ভাব: স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আগুন
স্বাধীন বাংলাদেশের পরপরই পাহাড়িদের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা। বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে তারা। তখন মঞ্চে আসেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা)—এক বলিষ্ঠ যুবনেতা, যিনি প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান।
লারমা ছিলেন একদিকে তুখোড় রাজনৈতিক কণ্ঠ, অন্যদিকে এক বিচক্ষণ সংগঠক। প্রথমে তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকার তার দাবিকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। এ থেকেই জন্ম নেয় শান্তিবাহিনী (Shanti Bahini)—পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (PCJSS) সশস্ত্র শাখা, যার নেতৃত্বে ছিলেন লারমা নিজেই।
শান্তিবাহিনী: ভারতীয় প্রশিক্ষণ ও বিদেশি সহায়তা
শান্তিবাহিনী সশস্ত্র আন্দোলনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হতে থাকে শেখ মুজিব নিহত হবার পর থেকে। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে তাদের ঘাঁটি তৈরি হয়, এবং RAW-এর সহায়তায় তারা ট্রেনিং, অস্ত্র ও আশ্রয় পায়। পাহাড়ের জঙ্গল, বাঁকে বাঁকে তখন গড়ে উঠছিল নতুন এক 'বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের' স্বপ্ন।
এই সুযোগে ধর্মান্তরের হার বাড়তে থাকে। মিশনারিরা লারমার এই আন্দোলনে ‘ধর্মীয় আবরণ’ যুক্ত করতে চায়। কিন্তু লারমা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পক্ষে। এ নিয়েই তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।
ভারত ও শান্তিবাহিনীর গোপন রসায়ন
ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘প্রক্সি যুদ্ধের মাঠ’ বানাতে চায়। ভারতের গোয়েন্দারা শান্তিবাহিনীকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়। লক্ষ্য ছিল: বাংলাদেশের উপর প্রেশার রাখা এবং নিজস্ব সীমান্ত সুরক্ষা।
সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা: সেনাবাহিনীর ওপর হামলা
১৯৭৭ সালে শান্তিবাহিনী তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে, যার প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর টহল দল। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশাদার মিলিশিয়ায় রূপ নেয়। RAW-এর সহায়তায় মিজোরাম ও ত্রিপুরার জঙ্গলে স্থাপন করে গোপন ঘাঁটি। সেখানে তাদেরকে দেওয়া হতো অস্ত্র, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ। এর মধ্য দিয়ে তারা একটি “স্বতন্ত্র পাহাড়ি রাষ্ট্র” গঠনের পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়।
জিয়ার কৌশল: “ডেমোগ্রাফিক শিফট” এর মাস্টারপ্ল্যান
মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। তখন তিনি বুঝে যান, পাহাড়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের নীলনকশা চলছে। তিনি এই ষড়যন্ত্র রুখতে চাল দেন এক যুগান্তকারী কৌশল—“বাঙালি পুনর্বাসন কর্মসূচি”।
১৯৭৯ থেকে শুরু হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে লক্ষাধিক মুসলমান পরিবারকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পুনর্বাসন করা হয়। পাহাড়ি জনসংখ্যার কাঠামো বদলে যায়। যেখান একসময় ৯০% পাহাড়ি ছিল, সেখানে এখন বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ভারত, মিশনারি, এমনকি লারমাও হতবাক। কারণ, এতে বিচ্ছিন্নতার ভিত্তিটাই নষ্ট হয়ে যায়।
ভারত তখন বিষয়টিকে দেখে সেভেন সিস্টার্সের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে। কারণ, যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা হয়, তবে ভারতের খ্রিস্টান-সংবেদনশীল রাজ্যগুলোতেও জাতিগত ভারসাম্য বদলাতে পারে।
শেখ হাসিনা'র দেশে আসা এবং জিয়া হত্যার নীল নকশা
ভারত হতবাক! শান্তিবাহিনী স্তম্ভিত! মিশনারিরা আঁচ করতে পারেনি তাদের ধর্মীয় প্রভাব জিয়া এভাবে পাল্টে দেবেন। পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীও ক্ষুব্ধ। এক পর্যায়ে ভারত তাদের পরবর্তী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠায়।
শেখ হাসিনা দেশে ফেরার মাত্র ১৩ দিন পরেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হন। অনেকে বলেন, এটি ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড। উদ্দেশ্য ছিল জিয়ার “ডেমোগ্রাফিক শিফট”-এর বিপরীতে ধর্মীয়-জাতিগত স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনাকে আবার জীবিত করে তোলা।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা
জিয়াউর রহমান হত্যার মাস না পার হতেই শান্তিবাহিনী প্রথমবারের মতো রাস্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ২৩ জুন ১৯৮১ সালে। শান্তিবাহিনী তৎকালীন বিডিআরের একটি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। তারা ১৩ জন সদস্যকে হত্যা করে এবং ২৪ জনকে বন্দি করে পরে গুলি করে হত্যা করে। এটি ছিল একটি ঘোষিত সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা, যেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এরশাদের ক্ষমতা দখল
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর, এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন।
এরশাদ তখন একদিকে ভারতপন্থী, অন্যদিকে সামরিক শাসক। তাঁর সময়েও পুনর্বাসন অব্যাহত থাকে। কিন্তু পাহাড়িরা তখন রুখে দাঁড়ায়। পাহাড়ে শুরু হয় সেনা অভিযান, নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ।
এমএন লারমার রহস্যজনক মৃত্যু: আদর্শের মৃত্যু না ষড়যন্ত্রের সফলতা?
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই বছর পর, ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর, পাহাড়ি রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হন নিজ দলের বিদ্রোহী অংশের গুলিতে। তাঁকে হত্যা করা হয় শান্তিবাহিনী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (PCJSS) অভ্যন্তরীণ এক ‘শুদ্ধি অভিযানের’ মাধ্যমে।
তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও অস্পষ্ট। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল তিন স্তরের ষড়যন্ত্রের ফল—
- ভারতের অস্বস্তি: লারমা জিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল। RAW চাইছিল শক্তিশালী শান্তিবাহিনী কিন্তু নিয়ন্ত্রিত নেতৃত্ব।
- মিশনারিদের অসন্তোষ: লারমা পাহাড়ি আন্দোলনকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি সব ধর্মাবলম্বী পাহাড়িকে একসঙ্গে আনতে চাইতেন—এতে খ্রিস্টান গোষ্ঠীর ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র’ পরিকল্পনায় বাঁধা পড়ে।
- অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ: PCJSS-এর একটি অংশ, যারা লারমার নেতৃত্বে সন্দিহান ছিল, তারা হয়তো ভারতের প্ররোচনায় নেতৃত্ব পরিবর্তন চেয়েছিল।
ফলে, নিজেরই সহকর্মীদের গুলিতে লারমা নিহত হন। কেউ বলেন, এটা ছিল RAW-মিশনারি-বিদ্রোহী ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র। শান্তিবাহিনী এরপর দীর্ঘদিন আর একক নেতৃত্বে ফিরতে পারেনি।
কিন্তু বিশ্লেষকরা একে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে মানতে রাজি নন।
অনেকেই মনে করেন—
“এই খুনের পেছনে ছিল RAW-এর অদৃশ্য হাত।”
RAW চাচ্ছিল এক “নমনীয়, কথামতো চলা” নেতা, যিনি শান্তিবাহিনীকে ধর্মীয় ও সন্ত্রাসভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তর করতে রাজি থাকবেন।
কিন্তু লারমা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিম মিলিত পাহাড়ি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তিনি ভারতের নির্দেশনায় চলতে রাজি ছিলেন না। ফলে, তাকে সরিয়ে দিয়ে নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় ভারতের প্রতি অনুগত অংশের হাতে। যাকে আমরা জানি 'সন্তু লারমা' হিসেবে!
এইভাবে জিয়া ও লারমা—দুই ভিন্ন মেরুর দেশপ্রেমিক—একই ষড়যন্ত্রের ছোবলে নিহত হন, যদিও তাদের আদর্শ ছিল আলাদা।
- জিয়া চেয়েছিলেন—এক রাষ্ট্র, একক সংস্কৃতি ও জনমিতিক ভারসাম্য।
- লারমা চেয়েছিলেন—আদিবাসী পরিচয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষ পাহাড়ি ঐক্য।
কিন্তু উভয়েই হয়ে উঠেছিলেন RAW-এর পরিকল্পনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
আর এই দুইজনের হত্যাই নিশ্চিত করে দেয়—পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আর শুধুমাত্র বাংলাদেশের একটি অঞ্চল নয়, বরং আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু।
জিয়া ও লারমা দুইজনের মৃত্যুর পর শান্তিবাহিনী মোড় নেয় "জাতিগত অধিকার"-এর আন্দোলন থেকে "সশস্ত্র জাতিগত সন্ত্রাস"-এর দিকে। হত্যা, অপহরণ, গ্রাম পোড়ানো, চাঁদাবাজি—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই ভারতীয়পন্থী নেতৃত্ব। পাহাড়ে শুরু হয় বাঙালি নিধনের এক ভয়ংকর অধ্যায়।
ধারাবাহিক হামলা ও জাতিগত নিধন: টার্গেট বাঙালি জনগণ
১৯৮৪ সালের ৩১ মে
রাঙ্গামাটির ভূষণছড়ায় ঘটে এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। শান্তিবাহিনীর সদস্যরা এক রাতে অন্তত ৪০০ বাঙালি পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে। গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ, শিশু—কেউ রেহাই পায়নি। আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিরীহ বাঙালি গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, মহিলাদের ওপর চালানো হয় ধর্ষণ। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধন, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি পুনর্বাসন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ভয় দেখানো এবং পাহাড়িদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
২৯ এপ্রিল ১৯৮৬: বাজার ঘেঁষা বাঙালি বসতিতে হামলা
এই দিনে তারা টার্গেট করে একটি সাপ্তাহিক হাট বসার সময়। সেখানে তারা ১৯ জন বাঙালিকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাটি এতটাই বীভৎস ছিল যে আশপাশের গ্রামগুলো রাতারাতি খালি হয়ে যায়।
২৬ জুন ১৯৮৯: ভোটদাতাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া
যেসব গ্রামবাসী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল, শান্তিবাহিনী সেগুলোকে "রাষ্ট্রীয় দালাল" আখ্যা দিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ভোট দেওয়া যেন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান—এই ‘অপরাধে’ তাদের বাড়ি-ঘড় পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।
১৯৯৬ সালের অপহরণ ও গণহত্যা
শান্তিবাহিনী ১৯৯৬ সালে একসঙ্গে ৩০ জন বাঙালিকে অপহরণ করে পরে হত্যা করে। তাদের মরদেহ গুম করে দেওয়া হয়। পরিবারগুলো কোনোদিন জানতে পারেনি—তাদের প্রিয়জন ফিরবে কি না।
শান্তিবাহিনী-চালিত ৩০০+ সশস্ত্র হামলা: আতঙ্কে এক যুগ
তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সেনাবাহিনীর গোপন নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—১৯৭৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছরে শান্তিবাহিনী ৩০০টিরও বেশি সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০০টির বেশি আক্রমণ ছিল বাঙালি বসতি, বাজার, হাট, সরকারি দপ্তর ও রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ চৌকিগুলোর ওপর। শুধু ১৯৮১ থেকে ১৯৮9 সাল পর্যন্ত সময়ে শান্তিবাহিনী প্রতি বছর গড়ে ১২–১৫টি সশস্ত্র অপারেশন চালিয়েছে। এসব হামলায় হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি কৃষক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারী নিহত হন বা গুম হয়ে যান। বহু নারী ধর্ষণের শিকার হন, শিশু ও বৃদ্ধরাও রেহাই পায়নি।
এইসব হামলা শুধুমাত্র ভৌগলিক দখলের জন্য পরিচালিত হয়নি—বরং এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে বাঙালিমুক্ত এক ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। সশস্ত্র সন্ত্রাসের পাশাপাশি আর্থিক নিপীড়ন, চাঁদাবাজি এবং সামাজিক বয়কট ছিল শান্তিবাহিনীর নিয়মিত কৌশল। এতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিদ্বেষমূলক বিভাজন স্থায়ী রূপ নেয়।
এরশাদের পতন ও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীত্ব
১৯৯০ সালের শেষ দিকে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সামরিক শাসনের অবসানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম তখনো আগুনে পুড়ছিল।
খালেদা জিয়ার সরকার কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করলেও, মূল রাজনৈতিক সমাধানে বাস্তব অগ্রগতি ছিল না। শান্তিবাহিনী ও সরকারের মধ্যে বারবার সংঘর্ষ, যুদ্ধবিরতির ভাঙন এবং জাতিগত অবিশ্বাস শুধু আরও তীব্র হয়। সেনা অভিযানে সহিংসতা কমলেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ ও বিদ্রোহপ্রবণ মনোভাব রাষ্ট্রীয় শাসনকে একপ্রকার অচল করে তোলে।
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির নামে পাহাড়ে স্থায়ী সংকট?
১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেয়। বছরের পর বছর ধরে চলা অস্ত্রের ভাষাকে থামিয়ে সংলাপ ও আলোচনার পথ ধরেন তিনি।
অবশেষে, দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ‘ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি’।
শেখ হাসিনা নিজে এই চুক্তিকে একটি আন্তর্জাতিক সফলতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। তাঁর আশাবাদ ছিল—এই পদক্ষেপ তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে নোবেল পুরস্কারের উপযুক্ত করে তুলবে।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। চুক্তির ফলে শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমা দিলেও, তাদের অনেক সদস্য পরে পাহাড়ের অভ্যন্তরে নতুন নামে সশস্ত্র রাজনীতি ও অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। চুক্তির মাধ্যমে যদিও একটি কাঠামোগত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো—জাতিগত পরিচয়, জমির মালিকানা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, এবং স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থা—এখনো সমাধান হয়নি। বরং এই চুক্তিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একাংশ মনে করে "বিশ্বাসঘাতকতা", আর বাঙালিরা মনে করে "তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে"।
উপসংহার: পাহাড়ের আগুন এখনো নিভেনি
১৯৯৭ সালের চুক্তি কাগজে-কলমে যুদ্ধ বন্ধ করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি এখনো রক্ত-ভেজা ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। পাহাড়ে আজও চলছে ছায়াযুদ্ধ—নতুন মুখোশে, নতুন নেতৃত্বে, নতুন কৌশলে। শান্তিবাহিনীর অস্ত্র নামলেও, তাদের ‘চেতনাগত যুদ্ধ’ এখনও শেষ হয়নি। পাহাড় আজো গভীর ষড়যন্ত্র, আন্তর্জাতিক স্বার্থ ও আদর্শিক সংঘাতের একটি বিপজ্জনক ল্যাবরেটরি।
এই গল্প এক গভীর ষড়যন্ত্র, জাতিগত পালাবদল ও আন্তর্জাতিক টানাপোড়েনের নাম। এবং হয়তো আগামী দশকে এখান থেকেই উন্মোচিত হবে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন মানচিত্রের গল্প।
কেউ বলবে—এটা ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’। কেউ বলবে—‘গোপন ক্রুসেড’।
তবে ইতিহাস জানে—জমি জিততে হলে, মানুষের মন জয় করতে হয়।
আর জিয়াউর রহমান, সেই পাহাড়ে প্রথম যে নীরবে বিজয়ের বীজ বপন করেছিলেন। সেই বিজয় ধ্বংস করার জন্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে শেখ হাসিনা। তিনি সফল না হলেও সম্ভবত শেখ হাসিনা'র বাকি কাজ শেষ করতে মাঠে নেমেছে শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া স্বপ্নের দল 'বিএনপি'! সেটা বুঝে না কি না বুঝে সেটা তারাই ভালো জানে!
অনেকে ভাবতে পারেন মায়ানমার ইস্যু কিংবা মানবিক করিডোর এর সাথে এসব ইতিহাসের কি কানেকশন! অবশ্যই কানেকশন আছে। এই নোবেল জয়ের আশায় শেখ হাসিনা দেশকে দুই বার ডুবিয়েছেন এবং নিজেও ডুবেছেন! একবার ডুবিয়েছেন শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যা থেকে আমরা আজও বের হতে পারিনি। আরেক বার ডুবিয়েছেন রোহিঙ্গাদের কে আশ্রয় দিয়ে। কিন্তু নোবেল আর তার ভাগ্যে জুটেনি! সেটা যার ভাগ্যে জুটেছে সে আমাদের ডুবন্ত অবস্থা থেকে তুলে আনার চেষ্টা করছেন।
যা শুরু হবে ৩য় অধ্যায় থেকে। আগামীকাল প্রকাশ হবে ২য় অধ্যায়।
মতামত দিতে এই ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করতে পারেন। ব্লগে কমেন্ট ও সাইন আপ রিলেটেড বিষয় গুলোর কাজ চলমান আছে।