ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ - ১৯ লাখ নতুন শরণার্থী গ্রহণ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ?

এই প্রতিবেদনে ভারত থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ‘পুশ-ইন’ কার্যক্রমের একটি বিশদ পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে সম্ভাব্য হুমকি নিয়ে আলোচনা করেছি, যা একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে।
‘পুশ-ইন’ বলতে বোঝানো হয় সেই প্রক্রিয়াকে, যেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF), কূটনৈতিক প্রটোকল বা যথাযথ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ভারতীয় নাগরিকদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।
২০২৫ সালের মে মাসের শুরু থেকে এই ধরনের ঘটনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইতোমধ্যে এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনটিতে এসব পুশ-ইনের ধরণ, প্রবণতা, পরিচয় সংকট, ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, এর মানবিক ও আইনি প্রভাবও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
সংজ্ঞা ও প্রেক্ষাপট
ভারত-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ‘পুশ-ইন’ বলতে বোঝায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সীমান্ত পেরিয়ে ব্যক্তিদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানোর কাজ। এ ধরনের কার্যক্রমে সাধারণত টার্গেট করা হয় বাংলা ভাষা-ভাষী মুসলমানদের, যাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও বহু ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতের দীর্ঘমেয়াদি বাসিন্দা এবং তাদের অনেকেরই বৈধ ভারতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।
এই ধরনের পুশ-ইন প্রক্রিয়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লঙ্ঘন করে, যার মধ্যে রয়েছে:
- ১৯৭৫ সালের ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সীমান্ত কর্তৃপক্ষ নির্দেশিকা
- ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (CBMP)
- বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) ও BSF-এর মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ
মোট পুশ-ইনের সংখ্যা
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ৭ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত সময়কালে মোট ১,০৫৩ জন ব্যক্তিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে।
সময়কাল | পুশ-ইনের সংখ্যা | উৎস |
---|---|---|
৭-১৫ মে, ২০২৫ | ৩৭০ | দ্য ডেইলি স্টার |
৭-২৮ মে, ২০২৫ | ১,০৫৩ | বিজিবি সদর দপ্তর, দ্য ডেইলি স্টার মাধ্যমে |
ভৌগোলিক বণ্টন
এই পুশ-ইন ঘটনাগুলো বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে ঘটেছে, যার মধ্যে মৌলভীবাজারে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুশ-ইন ঘটেছে, এরপর রয়েছে খাগড়াছড়ি এবং সিলেট। জেলাভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
🔹 মৌলভীবাজার – সর্বাধিক পুশ-ইনের ঘটনা
🔹 খাগড়াছড়ি – দ্বিতীয় সর্বোচ্চ
🔹 সিলেট – তৃতীয় অবস্থানে
জেলা | পুশ-ইনের সংখ্যা | মোটের শতকরা হার |
---|---|---|
মৌলভীবাজার | ৩৩১ | ৩১.৪% |
খাগড়াছড়ি | ১১১ | ১০.৫% |
সিলেট | ১০৩ | ৯.৮% |
কুড়িগ্রাম | ৮৪ | ৮.০% |
লালমনিরহাট | ৭৫ | ৭.১% |
সুন্দরবন (মান্দারবাড়িয়া) | ৭৮ | ৭.৪% |
ঝিনাইদহ | ৪২ | ৪.০% |
ফেনী | ৩৯ | ৩.৭% |
পঞ্চগড় | ৩২ | ৩.০% |
মেহেরপুর | ৩০ | ২.৮% |
সাতক্ষীরা | ২৩ | ২.২% |
হবিগঞ্জ | ১৯ | ১.৮% |
ঠাকুরগাঁও | ১৯ | ১.৮% |
চুয়াডাঙ্গা | ১৯ | ১.৮% |
চাঁপাইনবাবগঞ্জ | ১৭ | ১.৬% |
সুনামগঞ্জ | ১৬ | ১.৫% |
কুমিল্লা | ১৩ | ১.২% |
দিনাজপুর | ২ | ০.২% |
মোট | ১,০৫৩ | ১০০% |

সময়
২০২৫ সালের মে মাসের শুরু থেকে পুশ-ইন ঘটনাগুলোতে একটি স্পষ্ট বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
- ৬ থেকে ৯ মে পর্যন্ত প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ২৮০–৩০০ জন ব্যক্তি পুশ-ইন করা হয়েছে
- মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৭০ জনে
- ২৮ মে’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট পুশ-ইনের সংখ্যা ১,০০০ ছাড়িয়ে গেছে
অর্থাৎ, তিন সপ্তাহের ব্যবধানে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে, এবং মে মাসের শেষার্ধে এই হার আরও দ্রুত বেড়েছে।
জনতাত্ত্বিক গঠন
যদিও প্রতিটি পুশ-ইন ঘটনার জন্য পূর্ণাঙ্গ জনতাত্ত্বিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি, তবে বিদ্যমান রিপোর্টসমূহ থেকে নিচের গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতাগুলো উঠে এসেছে:
1. জাতীয়তা:
- অধিকাংশ ব্যক্তি 'সন্দেহভাজন বাংলাদেশি নাগরিক', যারা দীর্ঘ ২০–২৫ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছেন।
- কমপক্ষে ৫ জন ছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থী, যাদের কাছে ভারত সরকারের মাধ্যমে দেওয়া জাতিসংঘের UNHCR প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশন কার্ড ছিল
- কমপক্ষে ৩ জন নিশ্চিতভাবে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন
2. বয়স ও লিঙ্গ:
- পুশ-ইনের মধ্যে পুরুষ, নারী এবং শিশু—সব শ্রেণির মানুষ রয়েছেন
- একাধিক পরিবার পুশ-ইনের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশু ও সদ্যোজাত শিশুও রয়েছে
- কিছু ক্ষেত্রে ৬ বছর বয়সী শিশুদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে
3. পরিচয়পত্রের অবস্থা:
- অনেক ব্যক্তির ভারতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে
- কিছু শিশু ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তাদের কাছে ভারতীয় নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নথি ছিল
- উল্লিখিত ৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর কাছে বৈধ UNHCR কার্ড ছিল
এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত করে যে পুশ-ইন প্রক্রিয়াটি কেবল সন্দেহভাজন অভিবাসীদের নয়, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শরণার্থীদের ওপরও প্রভাব ফেলছে, যা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আঞ্চলিক বিশ্লেষণ
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত (সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ)
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি পুশ-ইন ঘটেছে, যা মোট ঘটনার প্রায় ৪৩%। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা:
- সিলেট ও ছাতকের মোকামপুঞ্জি, মিনাটিলা ও জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ৮২ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে
- সিলেট (৩২ জন) এবং মৌলভীবাজার (১২১ জন) সীমান্ত দিয়ে মোট ১৫৩ জনকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে
উত্তর সীমান্ত (কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়)
উত্তরাঞ্চলের সীমান্তগুলোতে মোট ঘটনার প্রায় ১৮% পুশ-ইন ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা:
- ৫ জন UNHCR-নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে পুশ-ইন
- ১৩ জন ব্যক্তি লালমনিরহাট সীমান্তের শূন্য রেখায় আটকে পড়েছেন
দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত (খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা)
এই অঞ্চলে মোট ঘটনার প্রায় ১৫% পুশ-ইন ঘটেছে। কিছু গুরুতর ঘটনা:
- একটি পরিবার (৫ জন) ফেনী নদী হয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন
- খাগড়াছড়ি সীমান্তের নির্জন এলাকাতে একাধিক ব্যক্তিকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত (সুন্দরবন, সাতক্ষীরা)
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে সুন্দরবনের দুর্গম এলাকা, প্রায় ১০% পুশ-ইন ঘটনার জন্য দায়ী। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
- সুন্দরবনের মন্দারবাড়িয়া এলাকার গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে ৭৮ জনকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে
এই আঞ্চলিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কৌশলগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করে পুশ-ইন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য একটি গভীর উদ্বেগের কারণ।
পদ্ধতি ও প্রেক্ষাপট
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিবেদনে পুশ-ইন কার্যক্রমে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা উঠে এসেছে:
1. পরিবহন (Transportation):
- অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, সীমান্ত এলাকা থেকে অনেক দূরের ভারতীয় রাজ্য—যেমন গুজরাট, হরিয়ানা, ও রাজস্থান থেকে গ্রেফতার করে সীমান্তে এনে তাদের পুশ-ইন করা হয়েছে।
2. সময় নির্বাচন (Timing):
- পুশ-ইন কার্যক্রম সাধারণত রাতের বেলায় বা ভোরবেলা সংঘটিত হয়,
- এর উদ্দেশ্য হলো অবশ্যই জনমানবহীন ও দুর্গম এলাকায় গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা, যাতে স্থানীয়রা টের না পায়।
3. নথিপত্র জব্দ (Documentation):
- অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাদের পরিচয়পত্র ও ব্যক্তিগত সামগ্রী পুশ-ইনের আগে জব্দ করা হয়েছে, ফলে তারা পরিচয়হীন অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়েছে।
4. শারীরিক পদ্ধতি (Physical Methods):
- কেউ কেউ জানিয়েছেন, জোরপূর্বক সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার করানো হয়েছে
- একটি ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, লোকজনকে খালি প্লাস্টিকের বোতলে বেঁধে ফেনী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা স্রোতে ভেসে বাংলাদেশে পৌঁছে যায়
- কিছু ভুক্তভোগীকে চোখ বেঁধে (ব্লাইন্ডফোল্ড করে) গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া ও সীমান্তে ফেলে রেখে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে
এই বিবরণগুলো পুশ-ইন কার্যক্রমের পূর্বপরিকল্পিত, সংগঠিত ও মানবাধিকারবিরোধী প্রকৃতি তুলে ধরে, যা কেবল আইন লঙ্ঘন নয়, বরং মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী একটি পদ্ধতিগত সহিংসতা।
মানবিক উদ্বেগসমূহ (Humanitarian Concerns)
পুশ-ইন অভিযানের কারণে একাধিক মানবিক উদ্বেগ উঠে এসেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো:
- অনেক ভুক্তভোগী নির্যাতন, শারীরিক নিপীড়ন এবং অমানবিক আচরণের অভিযোগ করেছেন, যেগুলো তারা সীমান্ত পার করানোর আগে সহ্য করেছেন।
- কিছু ক্ষেত্রে পুরো পরিবারকে একসাথে পুশ-ইন না করে, ভিন্ন ভিন্ন সময় ও স্থানে আলাদা করে সীমান্ত পার করানো হয়েছে, ফলে সন্তান ও অভিভাবকদের বিচ্ছেদ ঘটেছে।
- সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী, শিশু এবং স্বীকৃত শরণার্থীদের মতো দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী।
- অধিকাংশ ভুক্তভোগী খাদ্য, পানি এবং পর্যাপ্ত পোশাক ছাড়া দুর্গম এলাকাগুলোতে ফেলে আসা হয়েছে, যার ফলে তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
- অনেকেই আহত, অসুস্থ বা কঠিন আবহাওয়ায় পড়ে গেছেন, কারণ তারা নির্জন ও কঠিন পরিবেশে ফেলে আসার ফলে ঠান্ডা, পানিশূন্যতা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে পৌঁছেছেন।
পুশ-ইন ঘটনার মূল পরিচয়সংক্রান্ত সমস্যা
এই অংশে ভারত থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক পুশ-ইন ঘটনার পরিচয়সংক্রান্ত দিক বিশ্লেষণ করে, বিশেষত নথিপত্র জটিলতা, যাচাই প্রক্রিয়া ও পরিচয়পত্র ঘিরে বিতর্কগুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
একাধিক বিশ্বাসযোগ্য উৎসের ভিত্তিতে, এই বিশ্লেষণ দেখায় কিভাবে পরিচয় যাচাই এবং দলিলপত্র এই সীমান্ত পারাপারের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের মে মাসের শুরু থেকে ১,০০০-এর বেশি ব্যক্তিকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে।
১. পরিচয়পত্র জব্দ
একাধিক সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পুশ-ইনের আগে ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র জব্দ করছে। জব্দকৃত কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে:
- আধার কার্ড: ভারতের প্রধান পরিচয়পত্র (National ID Card), যা অনেক বাসিন্দার ছিল
- ভোটার আইডি কার্ড: ভারতের নাগরিকদের জন্য ইস্যু করা নির্বাচনী পরিচয়পত্র
- অন্যান্য বাসস্থান প্রমাণ: ভারতে দীর্ঘদিনের বসবাসের প্রমাণস্বরূপ কাগজপত্র
দ্য ডেইলি স্টার জানায়, “রাজস্থান, গুজরাট ও ত্রিপুরায় আটককৃতদের মধ্যে অনেকেই বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় মুসলমান, যাদের কারো কাছে বৈধ আধার কার্ড, ভোটার আইডি এবং দশকের পুরনো বাসস্থান সংক্রান্ত দলিল ছিল।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, “পুরো পরিবারকে এলোমেলোভাবে (Random) আটক করে আটক কেন্দ্রে পাঠানো হয়, এরপর সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।”
২. যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক
জাতীয়তা নির্ধারণের যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্টে সমালোচনা করা হয়েছে:
- দ্য ডেইলি স্টার উল্লেখ করে, পুশ-ইন কার্যক্রমগুলো “আইনি প্রক্রিয়া, যাচাই বা কূটনৈতিক সমন্বয় ছাড়াই” সম্পন্ন হচ্ছে
- কোচবিহারের বাসিন্দা ভুক্তভোগী ওবায়দুল খন্দকার বলেন, “তিনি তার ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখালেও বলা হয় যে সেগুলো যাচাই করতে হবে,” এবং কোনো যাচাই ছাড়াই তাকে আটক করা হয়
- অনেক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাদেরকে কোনো শুনানি ছাড়াই আটক করে সরাসরি সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে
৩. আধার কার্ড বাতিলের সরকারি নির্দেশনা
দ্য হিন্দু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রিপোর্ট করে, বিএসএফ একটি নীতির আওতায় সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীদের আধার কার্ড বাতিলের অনুরোধ করছে:
- “বিএসএফ পূর্ব সীমান্তে আটক হওয়া সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের আধার কার্ড বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অনুরোধ করছে”
- “কাউকে আটক করার পর, বিএসএফ স্থানীয় পুলিশকে জানায় এবং ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (UIDAI)-কে সেই ব্যক্তির আধার কার্ড বাতিল করতে বলে”
এই নীতি প্রমাণ করে যে, যাদেরকে অবৈধ অভিবাসী বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের পরিচয়পত্র বাতিল করার একটি সরকারি প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে।
৪. জাল পরিচয়পত্র সংক্রান্ত ঘটনা
যদিও বহু পুশ-ইন ভুক্তভোগীর কাছে বৈধ দলিল ছিল বলে জানা গেছে, তবুও কিছু ক্ষেত্রে জাল পরিচয়পত্র ব্যবহারের ঘটনাও সামনে এসেছে:
- নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ১৬ মে ২০২৫ তারিখের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিহারের গয়া জেলায় পবন ক্রান্তি বর্মা নামে এক বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করা হয়, যার কাছে অরুণাচল প্রদেশ থেকে ইস্যু করা একটি ভুয়া আধার কার্ড পাওয়া গেছে
- ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু পুশ-ইন অভিযানের যৌক্তিকতা হিসেবে পরিচয়পত্র জালিয়াতিকে উল্লেখ করেছে
৫. দীর্ঘমেয়াদী বাসিন্দাদের পরিচয় বিতর্ক
একটি বড় ধারা হলো এমন সব ব্যক্তিকে পুশ-ইন করা হচ্ছে, যারা বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন, অথচ এখন তাদের ভারতীয় পরিচয় অস্বীকার করা হচ্ছে:
- অনেক পুশ-ইন ভুক্তভোগী ২০–২৫ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন বলে জানা গেছে
- এই দীর্ঘমেয়াদী বাসিন্দাদের ভারতীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের সন্তানদের মধ্যে অনেকেই ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নথিপত্র ছিল
- বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) প্রধান বলেন, “পুশ-ব্যাক হওয়া অনেকেই এমন বাংলাদেশি, যারা বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। তাদের অনেকের সন্তান ভারতে জন্মেছে এবং ভারতীয় কাগজপত্র ছিল, যা জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া হয়েছে”
পরিচয় যাচাই নিয়ে সরকারি অবস্থান
ভারত সরকারের অবস্থান
ভারত সরকার পরিচয় যাচাই ও পুশ-ইন বিষয়ক একাধিক মন্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছে:
১. অবৈধ অভিবাসী দাবি:
“ভারত সরকার দাবি করেছে, ৪ মে ২০২৫ তারিখে গুজরাট থেকে ৩০০ জন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে বিমানযোগে ত্রিপুরায় এনে সড়কপথে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে।” (TBS News)
২. প্রত্যাবাসন পরিসংখ্যান:
“এক সরকারি কর্মকর্তার মতে, ২০২৪ সালে ২৯৫ জন বাংলাদেশিকে ‘প্রত্যাবাসন’ করা হয়েছে এবং ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করে বিজিবির (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।” (TBS News)
৩. পুশ-ব্যাক নীতি:
আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, “সরকার infiltration (অনুপ্রবেশ) ঠেকাতে আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সরাসরি 'পুশ-ব্যাক' ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” (TBS News, ১৫ মে ২০২৫)
৪. বাংলাদেশের উদ্বেগের জবাব:
বাংলাদেশের উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “এরা তাদের নাগরিক, সুতরাং তাদের গ্রহণ করাই উচিত।” (TBS News)
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
পরিচয় যাচাই সংক্রান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি আনুষ্ঠানিক অবস্থান গ্রহণ করেছে:
১. আইনি প্রক্রিয়ার অনুরোধ:
“বাংলাদেশ সরকার ভারতকে অনুরোধ করেছে যেন পুশ-ইন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়, কারণ যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া এ ধরনের কাজ দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।” (TBS News)
২. সঠিক যাচাইয়ের দাবি:
“বাংলাদেশ জানিয়েছে, এ ধরনের পুশ-ইন জনমনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করছে এবং কেবলমাত্র সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে, যাচাই-বাছাই করে যারা প্রকৃত বাংলাদেশি, তাদেরই গ্রহণ করা হবে।” (TBS News)
৩. ঘটনাগুলোর নথিভুক্তকরণ:
“বিজিবি প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ নথিপত্র তৈরি করে—ব্যক্তিগত সাক্ষ্য, চিত্র প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং সেগুলো যথাযথ কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে শেয়ার করে।” (The Daily Star)
আধার কার্ড ব্যবস্থা ও এর ভূমিকা
পরিচয়সংক্রান্ত বিরোধে ভারত সরকারের প্রদত্ত আধার কার্ড (Aadhaar Card) ব্যবস্থা একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে:
১. আধার (Aadhaar) কার্ডের উদ্দেশ্য:
আধার হলো একটি ১২-সংখ্যার Unique Identificatio Number, যা ব্যক্তির বায়োমেট্রিক ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হয় এবং ভারতের বাসিন্দাদের পরিচয় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. আধার (Aadhaar) পাওয়ার যোগ্যতা:
ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (UIDAI) অনুযায়ী, আধার শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়, বরং “ভারতের সব বাসিন্দার” জন্য উন্মুক্ত। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বাসিন্দারা—এমনকি যারা অবৈধ অভিবাসী হতে পারেন—তাদেরও আধার কার্ড পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
৩. যাচাইয়ের সীমাবদ্ধতা:
যদিও আধার (Aadhaar Card) পরিচয় যাচাইয়ে ব্যবহৃত হয়, এটি কোনো নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র নয়। ফলে দীর্ঘদিন ভারতে বসবাসকারী অনেকের ক্ষেত্রেই একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি বা ‘আইনি ধোঁয়াশা’ সৃষ্টি হয়েছে—যাদের কাছে আধার কার্ড থাকলেও তা নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় না।
৪. বাতিল প্রক্রিয়া:
বিএসএফ সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীদের আধার কার্ড বাতিলের জন্য UIDAI-কে অনুরোধ জানায়। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্য করে তোলা হয় বা তাদের অধিকার খর্ব করা হয়।
পরিচয়সংক্রান্ত বিরোধের কেস স্টাডি
এ অংশে আমি কয়েকটি কেস স্টাডি শেয়ার করছি। যা ভুক্তভোগীদের বক্তব্য এবং সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
কেস ১: ওবায়দুল খন্দকার
সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার
- ভারতের কোচবিহারের একজন বাসিন্দা
- কর্তৃপক্ষের কাছে ভারতীয় পরিচয়পত্র দেখান
- বলা হয়, কাগজপত্র “যাচাই” করতে হবে
- কোনো আইনি শুনানি ছাড়াই ১০ দিন আটক রাখা হয়
- পরিবারের কাউকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি
- ফিরে এসে দেখে তার ঘর লুট করা হয়েছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
কেস ২: সেলিনা বেগম ও তার পরিবার
সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার
- ৪১ বছর বয়সী নারী, তিন মেয়েসহ
- হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন
- ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আটক হন
- অর্থ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়
- খালি প্লাস্টিক বোতলে বেঁধে রাতের অন্ধকারে ফেনী নদীতে ঠেলে ফেলা হয়
- খাগড়াছড়ির রামগড় এলাকায় নদীতীর থেকে উদ্ধার করা হয়
কেস ৩: UNHCR কার্ডধারী রোহিঙ্গা শরণার্থী
সূত্র: একাধিক গণমাধ্যম
- পাঁচজন রোহিঙ্গা, যাদের UNHCR-এর কার্ড ছিল
- কার্ডগুলো দিল্লির UNHCR অফিস থেকে ইস্যু করা হয়েছিল
- আসামের মাতিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন
- কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়
- ভাওয়াল কুড়ি সীমান্ত সংলগ্ন নতুনহাট বাজার এলাকা থেকে বিজিবি তাদের আটক করে
কেস ৪: পবন ক্রান্তি বড়ুয়া
সূত্র: নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
- ৬২ বছর বয়সী বাংলাদেশি নাগরিক
- বিহারের গয়া জেলায় আটক হন
- অরুণাচল প্রদেশ থেকে ইস্যু করা একটি জাল আধার কার্ড পাওয়া যায়
- শুরুতে নিজেকে অরুণাচলের বাসিন্দা প্রফুল্ল চাকমা বলে দাবি করেন
- যাচাইয়ে প্রমাণ হয় আধার কার্ডটি ভুয়া
- বৈধ ভিসা ছাড়া ভারতে অবস্থানের দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়
পরিচয়সংক্রান্ত পুশ-ইন: প্যাটার্ন ও প্রবণতা
১. বাংলা-ভাষী মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পুশ-ইন কার্যক্রম মূলত বাংলা-ভাষী মুসলমানদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের নথিপত্র থাক বা না থাক:
- দ্য ডেইলি স্টার জানায়, ভারত “অবৈধ অভিবাসী” সন্দেহে, যাদের বেশিরভাগই বাংলা-ভাষী মুসলমান, জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে
- একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বাংলা-ভাষী মুসলমানরাও সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে”
২. ব্যক্তি পর্যায়ে যাচাই ছাড়া গণ-অভিযান
রিপোর্টগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বড় পরিসরের অভিযানে ব্যক্তিগতভাবে যাচাই না করেই পুশ-ইন কার্যক্রম চালানো হয়েছে:
- ৪ মে গুজরাট থেকে ৩০০ জনকে বিমানযোগে ত্রিপুরায় এনে সীমান্ত পার করানো হয়
- জয়পুর থেকে ১৪৮ জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে জোধপুরে পাঠিয়ে, সেখান থেকে কলকাতায় বিমানে পাঠানো হয়
- শুধু জয়পুর শহরেই প্রায় ১,০০০ জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে শনাক্ত করা হয়েছে
৩. আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সরাসরি পুশ-ব্যাক নীতি
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি স্বীকার করেছে যে তারা নীতিগতভাবে পরিবর্তন এনেছে:
- আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তারা “আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশ রোধে সরাসরি ‘পুশ-ব্যাক’ ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে”
- আগে সন্দেহভাজন অভিবাসীদের “গ্রেপ্তার করে... ভারতের আইনি ব্যবস্থায় আনা হতো... জেলে পাঠানো হতো এবং আদালতে হাজির করা হতো”
- এখন কর্তৃপক্ষ বলছে, “আমরা তাদের আর দেশের ভিতরে ঢুকতে দেব না, সরাসরি ঠেলে দেব”
৪. দলিলপত্র জব্দের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা
একাধিক সূত্র বলছে, দলিলপত্র জব্দ এখন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে:
- সীমান্ত পার করানোর আগে ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়
- ফলে, বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর ভুক্তভোগীদের পক্ষে নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে
- একইসঙ্গে, বাংলাদেশের পক্ষে প্রকৃত নাগরিকত্ব যাচাই করাও জটিল হয়ে যায়
আইনি ও মানবিক প্রভাব
১. আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন
পরিচয় যাচাই ঘিরে পরিচালিত পুশ-ইন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক মৌলিক নীতির পরিপন্থী:
- ICCPR-এর ধারা ১৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যিনি বৈধভাবে কোনো দেশে অবস্থান করছেন, তাকে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া নির্বাসন করা যাবে না
- ICCPR-এর ধারা ১২(৪) অনুযায়ী, কাউকে তার নিজ দেশে প্রবেশাধিকার থেকে ইচ্ছামতো বঞ্চিত করা যাবে না
- জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটির ব্যাখ্যায় দেখা যায়, এই অধিকারগুলো এমনকি দীর্ঘমেয়াদি বসবাসকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, এমনকি যদি তাদের বৈধ কাগজপত্র না-ও থাকে
২. দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লঙ্ঘন
পুশ-ইন কার্যক্রমে পরিচয় যাচাই সংক্রান্ত দিকগুলো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার বিভিন্ন চুক্তির পরিপন্থী:
- ১৯৭৫ সালের যৌথ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্দেশিকা
- ২০১১ সালের কোঅর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (CBMP)
- বিজিবি ও বিএসএফ-এর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে হওয়া সমঝোতা চুক্তিসমূহ
৩. মানবিক উদ্বেগ
পরিচয়সংক্রান্ত বিরোধগুলো একাধিক মানবিক সমস্যা সৃষ্টি করছে:
- পরিবার বিচ্ছিন্নতা: অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কারো কাগজপত্র থাকলেও অন্যদের না থাকায় আলাদা করে পুশ-ইন করা হচ্ছে
- রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকি: যাদের পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়েছে, তারা পরিচয়হীন ও রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ছেন
- শিশুদের ঝুঁকি: বিশেষ করে যারা ভারতের অভ্যন্তরে জন্মেছে এবং দীর্ঘমেয়াদি বাসিন্দার সন্তান, তারা অতিরিক্তভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে
প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া:
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB):
- সীমান্তের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে নজরদারি ও টহল জোরদার করা হয়েছে।
- প্রতিটি পুশ-ইন ঘটনার আলাদা করে ডকুমেন্টেশন করা হচ্ছে—ব্যক্তিগত সাক্ষ্য ও দৃশ্যমান প্রমাণসহ।
- সীমান্তে ফেলে দেওয়া ব্যক্তিদের জরুরি মানবিক সহায়তা (খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয়) প্রদান করা হয়েছে।
কূটনৈতিক উদ্যোগ:
- ২০২৫ সালের ৯ মে ভারত সরকারকে কূটনৈতিক বার্তা (Note Verbale) পাঠিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
- একতরফাভাবে চালানো পুশ-ইন অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
- বৈধ বাংলাদেশি নাগরিকদের যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ।
ভারতের সরকারের অবস্থান:
সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি:
- পুশ-ইন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এখনো সীমিত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
- কিছু রাজ্য বা আঞ্চলিক কর্মকর্তারা জনসমক্ষে অবৈধ অভিবাসী ফেরত পাঠানোর বিষয় আলোচনা করেছেন।
- ভারতের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় (MEA) এ বিষয়ে কূটনৈতিক প্রশ্নের জবাবে "গভীর নীরবতা" বজায় রেখেছে।
আঞ্চলিক ভিন্নতা:
- রাজস্থান রাজ্যের আইনমন্ত্রী যোগারাম প্যাটেল জনসমক্ষে বলেছেন, "বাংলাদেশিদের" কলকাতায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।
- আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা খোলাখুলিভাবে “পুশব্যাক মেকানিজম” সমর্থন করেছেন এবং সেটিকে কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এই প্রতিক্রিয়া-প্রতিসংবাদের জটিলতা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং মানবিক সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, ২০২৫ সালের মে মাসের শুরু থেকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন কার্যক্রম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহে ১,০০০-এরও বেশি মানুষ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক পাঠানো হয়েছে—যা এক অভূতপূর্ব মানবিক ও কূটনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়।
- ভূগোলভিত্তিক বণ্টন:
বেশি সংখ্যক পুশ-ইন ঘটেছে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল, বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলায়। - জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য:
নারী, শিশু এবং স্বীকৃত শরণার্থীসহ অসহায় জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। - ব্যবহৃত পদ্ধতি:
রাতের বেলায় দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়া, পরিচয়পত্র জব্দ করা, এবং কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এসব কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনের পরিপন্থী করে তুলেছে।
বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণ মাত্রা ও প্রভাব বুঝতে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংকট শুধু মানবিক নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিচয়পত্র ও পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়া বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ পুশ-ইন সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আধার কার্ডসহ বিভিন্ন পরিচয়পত্র জব্দ, তাদের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক, এবং আইনি যাচাই পরিহার করে সরাসরি পুশ-ব্যাক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়া—সব মিলিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল মানবিক ও কূটনৈতিক সংকটে পরিণত করেছে।
প্রসঙ্গ: আসাম NRC ও রাষ্ট্রহীনতার নতুন ঝুঁকি
এই পরিচয়সংক্রান্ত সংকটের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতের আসাম রাজ্যে ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC) তালিকা থেকে প্রায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষকে তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করেছে। ফলে তারা এখন কার্যত 'রাষ্ট্রহীন' (stateless) অবস্থায় রয়েছেন। এদের একটি বড় অংশ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান, যারা বহু দশক ধরে ভারতে বসবাস করছেন।
এই নাগরিকত্ব সংকট থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ এখন সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে পুশ-ইন নীতি বাস্তবায়নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে—যার ফলে যাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যাচ্ছে না, তাদের সরাসরি সীমান্তে ফেলে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি করণীয়
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এটি একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। কারণ:
- আসাম NRC-এর বাদপড়া জনগোষ্ঠী থেকে অনেককে ভবিষ্যতে “অবৈধ বাংলাদেশি” হিসেবে চিহ্নিত করে পুশ-ইন করা হতে পারে।
- এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করলে সামাজিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা হুমকি ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
- বিজিবি, এনএসআই ও প্রশাসনের উচিত প্রতিটি ভুক্তভোগীর জীবন ইতিহাস, জন্মস্থান, নথিপত্র ও পারিবারিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে পূর্ণাঙ্গ যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
- পাশাপাশি সীমান্ত এলাকাগুলোতে ইলেকট্রনিক নজরদারি, বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, ভারত থেকে পুশ-ইন কেবল সাময়িক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি বৃহত্তর জনসংখ্যাগত রূপান্তর এবং কৌশলগত রাষ্ট্রীয় পুনর্বিন্যাসের অংশ। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এখনই সমন্বিত ও তথ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
References
- The Business Standard. (May 13, 2025). "New tensions at the border: What India's push-ins mean and why Bangladesh must act now."
- The Daily Star. (May 14, 2025). "India must stop border push-ins."
- The Daily Star. (May 21, 2025). "India's 'push-in' policy: What is the message for Bangladesh?"
- The Daily Star. (May 28, 2025). "Bangladesh alleges rights abuses as push-ins from India cross 1,000."
- Prothom Alo English. (May 14, 2025). "Why India's border 'push-ins' are unwarranted."
- New Age. (May 28, 2025). "India pushes 82 more into Bangladesh."
- TBS News. (May 26, 2025). "BSF pushes 394 individuals in 20 days thru Sylhet, adjacent borders."
- India Today. (May 28, 2025). "13 stuck at Zero Line as India, Bangladesh dig heels on illegal immigrants."
- The Hindu. (September 29, 2024). "BSF asks UIDAI to deactivate Aadhaar of undocumented migrants from Bangladesh."
- TBS News. (May 15, 2025). "Push-ins: India claims they are sending back Bangladeshis held without documents."
- New Indian Express. (May 16, 2025). "Bangladeshi national arrested in Bodh Gaya; fake Aadhar card, documents recovered."
- https://bdnews24.com/bangladesh/e55093371f63
- https://www.tbsnews.net/bangladesh/bgb-locals-foil-bsf-attempt-push-750-indian-nationals-thru-brahmanbaria-border-1143681
- https://www.thehindu.com/news/national/india-pushing-back-illegal-immigrants-to-bangladesh/article69621925.ece
- https://unb.com.bd/category/Bangladesh/bgb-foils-indian-bsfs-attempts-to-push-in-57-people-into-bangladeshs-lalmonirhat/160774
- https://www.indiatoday.in/world/story/illegal-bangladeshi-from-india-push-ins-unacceptable-ready-to-step-in-if-needed-bangladesh-army-2730909-2025-05-26
- https://www.indiatoday.in/world/story/thirteen-stuck-at-zero-line-india-bangladesh-army-dig-heels-illegal-immigrants-border-guard-bangladesh-2732046-2025-05-28
- Youtube Video
