ইসরাইল-ইরান সংঘাত: ভূ-রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা?

এর ফলে ইরানের সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে। একদিকে, তারা সীমিত মিসাইল হামলা চালিয়ে প্রতিশোধের ইঙ্গিত দিতে পারে, অন্যদিকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমেরিকার সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হতে পারে।

ইসরাইল-ইরান সংঘাত: ভূ-রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা?

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের কৌশলগত উত্তেজনার পর অবশেষে ইসরাইল সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এই হামলাগুলো লক্ষ্যভেদে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিচালিত হয়েছে।

এসব হামলায় ইরানের আইআরজিসি প্রধান সালামি এবং কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর নিহত হওয়ার খবর এসেছে, যা ইরানের নিরাপত্তা ও কৌশলগত পরিকাঠামোতে একটি বড় আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ ইসরাইলের কৌশলগত হিসাব-নিকাশ।

ইসরাইল জানে, বর্তমানে ইরানের জবাব দেওয়ার সক্ষমতা খুবই সীমিত এবং সেই সুযোগটিই তারা কাজে লাগিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়া প্রভাব।

সিরিয়ায় বিদ্রোহী নেতা জোলানি ক্ষমতা দখল করেছে এবং ইরানের সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো সেখান থেকে একে একে পিছিয়ে গেছে।

লেবাননে হিজবুল্লাহ সংগঠন রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে চাপে আছে, এবং ইরান তাদের পুরনোভাবে আর সমর্থন দিতে পারছে না।

ফলে সিরিয়া এবং লেবানন এখন ইসরাইলের জন্য কার্যকর বাফার জোন হিসেবে কাজ করছে, যা ইসরাইলকে সরাসরি সামরিক ঝুঁকি থেকে আংশিকভাবে মুক্ত রেখেছে।

এদিকে ইরানের সামরিক সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল। তাদের এয়ারফোর্স অত্যন্ত সীমিত, পুরনো প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং আধুনিক বিমান যুদ্ধের উপযোগী নয়।

স্থলপথে হামলা চালানোর কোনো কার্যকর পথ বর্তমানে তাদের নেই, কারণ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

তদুপরি, পারস্য উপসাগরে আমেরিকান ও পশ্চিমা দেশগুলোর নৌবাহিনীর তীব্র উপস্থিতি ইরানের জন্য বাড়তি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

সুতরাং ইরান সীমিত সংখ্যক মিসাইল হামলা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। অন্যদিকে, ইসরাইলের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক এয়ারফোর্স, দূরপাল্লার জেন্টি মিসাইল, উন্নত গোয়েন্দা প্রযুক্তি এবং সম্ভাব্য আরব দেশগুলোর ঘাঁটি ব্যবহারের সুবিধা।

এর ফলে ইরানের সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে।

একদিকে, তারা সীমিত মিসাইল হামলা চালিয়ে প্রতিশোধের ইঙ্গিত দিতে পারে, অন্যদিকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমেরিকার সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হতে পারে।

যদি ইরান আমেরিকার শর্ত মেনে নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটিগুলো সীমিত বা বন্ধ করে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হবে মারাত্মক—পুরো মুসলিম বিশ্বের ওপর পশ্চিমা প্রভাব আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভূ-রাজনীতিতে ইরানের অবস্থান আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

আধুনিক যুগে যুদ্ধের পরিবর্তে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে যুদ্ধের মাধ্যমেই নয়, বরং কৌশলগত রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে অনেক মুসলিম দেশ ইতিমধ্যেই আমেরিকা ও ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ পশ্চিমা সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তার বিনিময়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছে, যা একটি বৃহত্তর পশ্চিমা কাঠামোর অংশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ইরানকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে।

বিশেষ করে ইরানের সাবেক ধর্মীয় নেতা খোমেনির ঘোষিত ফতোয়া, যেখানে তিনি এটম বোমা বানানোকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, এখন সময়ের প্রেক্ষাপটে তা অব্যবহারযোগ্য বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য সবসময়ই ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই অঞ্চল বিশ্বের জ্বালানি রপ্তানির কেন্দ্র এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের মোক্ষম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমানে আবারও এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই সংঘাত ও পালাবদল মুসলিম বিশ্বের জন্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে এবং অনেকের মতে এটি ইমাম মাহদী ও ঈসা নবীর আগমনের জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও গড়ে তুলছে।

এই সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামরিক মানচিত্র কীভাবে বদলে যাবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটি নিশ্চিত, ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্ব আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

Read more

ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি: ২০২৪-২৫ এর টানাপোড়েন ও ভূরাজনৈতিক পালাবদল

ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি: ২০২৪-২৫ এর টানাপোড়েন ও ভূরাজনৈতিক পালাবদল

শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে—দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা, নিষেধাজ্ঞা, চীন-ঘনিষ্ঠতা ও নির্বাচন ঘিরে পরিবর্তনের বিস্তৃত বিশ্লেষণ পড়ুন এখানে। জেনে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক যুদ্ধের কারণগুলো!

By Rashed Hasan Akash
ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ - ১৯ লাখ নতুন শরণার্থী গ্রহণ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ?

ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ - ১৯ লাখ নতুন শরণার্থী গ্রহণ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ?

এই প্রতিবেদনে ভারত থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ‘পুশ-ইন’ কার্যক্রমের একটি বিশদ পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্

By Rashed Hasan Akash
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও সম্ভাব্য রাষ্ট্র গঠন ও বাংলাদেশের ঝুঁকি!

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও সম্ভাব্য রাষ্ট্র গঠন ও বাংলাদেশের ঝুঁকি!

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে অত্যন্ত জটিল এবং বিভক্ত। দেশের ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী

By Rashed Hasan Akash
ভূ-রাজনীতির ছায়াযুদ্ধঃ জঙ্গি জঙ্গি খেলা - দেশ ছাড়িয়ে আরাকানে!

ভূ-রাজনীতির ছায়াযুদ্ধঃ জঙ্গি জঙ্গি খেলা - দেশ ছাড়িয়ে আরাকানে!

প্রথম পর্ব পড়ে আসুন আগেঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, পুনর্বাসন, আর এক রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (9/11)

By Rashed Hasan Akash